টানা তাপপ্রবাহে লিচুর ফলনে বিপর্যয়, দাম চড়া
পাকা লিচুর রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে পাবনার ঈশ্বরদী। ইতিমধ্যে মোজাফ্ফর জাতের দেশি লিচুর সঙ্গে সুস্বাদু বোম্বাই জাতের লিচু বাজারে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু চলতি মৌসুমে টানা তাপপ্রবাহে লিচুর ফলন তেমন ভালো হয়নি। একটি গাছে গত বছর যেখানে অন্তত পাঁচ হাজার লিচু পাওয়া যেত, এবার সেই গাছে লিচু মিলছে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার। এবার চড়া দাম দিয়ে লিচু খেতে হবে, বলছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পাবনার ৯টি উপজেলায় চলতি বছর মোট ৪ হাজার ৭২১ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঈশ্বরদীতেই আবাদ করা হয়েছে ৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে। এবার ৩৬ হাজার মেট্রিক টন লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষক উন্নয়ন সোসাইটির উপদেষ্টা ও লিচুচাষি শাহজাহান আলী প্রথম আলোকে বলেন, ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা লিচুর উৎপাদন ব্যাহত করে। এবার গ্রীষ্মের পুরো সময়ে তাপমাত্রা ৩৭ থেকে ৩৮ ডিগ্রির ওপরে ছিল। জেলার ওপর দিয়ে কয়েক দিন প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। এতে গুটি অবস্থায় অনেক লিচু ঝরে গেছে। যেগুলো গাছে ছিল, সেগুলো শুকিয়ে রং নষ্ট হয়েছে।
স্বর্ণপদক পাওয়া এই কৃষক বলেন, এবার ভালো মানের লিচু বাছাই করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রাকৃতিক কারণে লিচুর ফলনে বিরূপ প্রভাব পড়ায় বাজারে দাম বেশি। বর্তমান বাজারে প্রতিটি লিচু আড়াই থেকে তিন টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে চাষিদের লোকসানের আশঙ্কা নেই।
ঈশ্বরদী আবহাওয়া কার্যালয় সূত্র জানায়, গত ১৭ এপ্রিল থেকে টানা ১০ দিন জেলায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এর পর থেকে তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৪০ ডিগ্রির মধ্যে ছিল। মূলত মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর তাপমাত্রা কমতে শুরু করে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মাঝারি তাপপ্রবাহ, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং ৪২ ডিগ্রি বা এর বেশি হলে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়।
আজ বুধবার সরেজমিন দেখা গেছে, পাবনা-পাকশী আঞ্চলিক সড়ক ধরে ঈশ্বরদী উপজেলার দিকে যেতেই সড়কের দুই পাশে যত দূর চোখ যায়—শুধু লিচু বাগান। টুকটুকে লাল লিচুতে রঙিন হয়ে আছে বাগানগুলো। গাছ থেকে লিচু পাড়তে ব্যস্ত শ্রমিকেরা। নিচে নারী-পুরুষ মিলেমিশে বাছাইয়ের কাজ করছেন। বাছাইয়ের পর ঝুড়িতে সাজিয়ে বিক্রির জন্য লিচু পাঠানো হচ্ছে বাজারে।
ঈশ্বরদীর সাহাপুর ইউনিয়নের আওতাপাড়া গ্রামে বাগানে গিয়ে কয়েক পাইকারি লিচু ব্যবসায়ীর দেখা পাওয়া গেল। ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে লিচু কিনতে তাঁরা এসেছেন। সরাসরি বাগান থেকে লিচু কিনে সেই লিচু নিজ নিজ এলাকায় পাঠাচ্ছেন। টানা তাপপ্রবাহে ফলন বিপর্যয়ের কথা তাঁরাও স্বীকার করলেন। বাজারে লিচুর চড়া দামের পেছনেও উৎপাদন কম হওয়ার কারণ উল্লেখ করলেন কেউ কেউ।
ঢাকার ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এবার মৌসুমের শুরু থেকেই আবহাওয়া লিচুর প্রতিকূল ছিল। মুকুল আসার সময় বৃষ্টি হওয়ায় গাছেই অনেক মুকুল নষ্ট হয়ে গেছে। এরপর গুটি হওয়ার সময় শুরু হয় তাপপ্রবাহ। এতে একদিকে গুটি ঝরে যায়, অন্যদিকে গাছে লিচু বাড়তে পারেনি। বেশির ভাগ লিচু গাছেই শুকিয়ে গেছে। আশানুরূপ উৎপাদন হয়নি। প্রতিটি গাছ থেকে পাঁচ হাজার লিচুর প্রত্যাশা থাকলেও তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার লিচু পাওয়া যাচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর থেকে ঈশ্বরদীতে লিচু কিনতে এসেছেন ব্যবসায়ী রতন মিয়া। তিনি বলেন, গত বছর প্রতি হাজার লিচু ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায় কিনেছেন; বিক্রি করেছেন ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায়। এবার বাগান থেকেই আড়াই হাজার থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। খুচরা বাজারে তিন হাজার টাকার ওপরে লিচু বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘দাম বেশি হলেও বাজারে লিচুর চাহিদা ব্যাপক। আমাদের লোকসান হবে না। তবে ক্রেতাদের একটু বেশি দাম দিয়ে লিচু খেতে হবে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উন্নয়ন শাখার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রাকৃতিক কারণে লিচুর ফলনে বিরূপ প্রভাব পড়লেও বাজারে দাম ভালো থাকায় চাষিদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে বাগানমালিক কিংবা ব্যবসায়ীদের কেউ লিচুতে লোকসানে পড়বেন না।