গ্রামটি যেন সবুজের সমুদ্রে এক টুকরা দ্বীপ

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের চূড়ায় ছিমছাম, গোছানো ও পরিচ্ছন্ন মায়াবী এক গ্রাম নিরালাপুঞ্জি। গত ১৯ অক্টোবর তোলাছবি: সুমনকুমার দাশ

পাহাড়ের চূড়ায় ছিমছাম, গোছানো ও পরিচ্ছন্ন মায়াবী এক গ্রাম। বুনো বাতাসে হাজারো গাছগাছালি দুলছে। যেন সবুজের সমুদ্রে ঢেউয়ের খেলা! এক বিকেলে লোকালয় থেকে দূরে দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন গ্রামটিতে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।

গ্রামটির নাম নিরালাপুঞ্জি। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে গ্রামটির অবস্থান। বাসিন্দারা ধর্মীয় পরিচয়ে খ্রিষ্টান, জাতিতে খাসিয়া। দুর্গম এ জনপদে যেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।

উঁচু–নিচু সর্পিল কাঁচা–পাকা রাস্তা ধরে জিপগাড়িতে যাওয়া গেলেও অসাবধান হলে হাজার ফুট নিচে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আঁকাবাঁকা রাস্তায় অপর পাশের গাড়িও দেখা যায় না। চালক তখন উদ্বিগ্ন মনে অন্য চালককে জিজ্ঞাসা করেন, ‘সামনে কুনু গাড়ি আছে?’

শ্রীমঙ্গলে সপরিবার বেড়াতে গিয়ে গত ১৯ অক্টোবর নিরালাপুঞ্জিতে যাওয়া হয়। সঙ্গে ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা ও নাট্যকার মু. আনোয়ার হোসেন (রনি) ও তাঁর স্ত্রী রন্ধনশিল্পী ও উপস্থাপিকা কুমকুম হাজেরা (মারুফা)। তিন হাজার টাকায় ভাড়া করা জিপগাড়িতে চড়ে বেলা দেড়টার দিকে রওনা হয়ে বেশ কয়েকটি চা-বাগানের ভেতর দিয়ে ঘণ্টা দেড়েক পর গন্তব্যের দেখা মেলে। স্থানীয় গাইড তাজুল ইসলাম শুরুতেই নিয়ে গেলেন ‘মান্ত্রী’ তাহেরা পতামের বাড়ি। খাসিয়ারা পুঞ্জিপ্রধানকে ‘মান্ত্রী’ বলে। বংশপরম্পরায় এই পুঞ্জিপ্রধান নির্বাচিত হন।

মৌলভীবাজারের নিরালাপুঞ্জির চারপাশ গাছপালাবেষ্টিত। প্রতিটি বাড়ির উঠোনে আছে ফুলের গাছ। গত ১৯ অক্টোবর তোলা
ছবি : সুমনকুমার দাশ

খাসিয়াদের মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রচলন আছে। তাহেরা পতামও নারী। তবে বাড়িতে না থাকায় তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়নি। আলাপ হয় মান্ত্রীর সহকারী এলভিস পতামের সঙ্গে। তিনি জানান, ৪৫ বছর আগে পুঞ্জিটির (গ্রাম) গোড়াপত্তন। জেলা প্রশাসকের খাস খতিয়ানে থাকা ৯০০ একর জমি ইজারা নিয়ে মান্ত্রীর পরিবার গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করে। এখানকার বাসিন্দাদের মূল পেশা পান ও সুপারি চাষ। শুরুতে ১০ থেকে ১২টি খাসিয়া পরিবার ছিল। ধীরে ধীরে পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে।

এলভিসের সঙ্গে আলাপের পর বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় ঘুরে দেখা হয় পুরো গ্রাম। পুরুষেরা কাজ শেষে বাড়ি ফিরছেন। কেউবা পান নিয়ে আসছেন। কাউকে কাউকে বাড়ির পাশের পানগাছ পরিচর্যা করতে দেখা গেল। কোনো কোনো বাড়ির উঠান ঝাড়ু দিচ্ছেন নারীরা। এদিক-ওদিক খেলার ছলে ছুটে বেড়াচ্ছে শিশু-কিশোর। কোনো কোনো বাড়ির দাওয়ায় বসে দলবদ্ধ পুরুষেরা খোশগল্প করছেন।

এক বাড়ির মাটির দাওয়ায় প্লাস্টিকের চেয়ার আর মোড়ায় বসে খোশগল্প করছিলেন জন সুরং (২৮) ও গুড পতমি (২৪) নামের দুই তরুণ। পাহাড়ি জুমে কাজ শেষে তাঁরা বাড়ি ফিরে অবসর সময় কাটাচ্ছিলেন। কথা বলতে চাইলে হাসিমুখে রাজি হন।

দুই তরুণ জানালেন, পান চাষই তাঁদের মূল পেশা। পান তুলে বাড়ির নারীদের কাছে দেন। পরে নারীরা সেই পান বেছে রাখেন। সেসব পানই ব্যবসায়ীরা গ্রামে এসে পাইকারি দরে কিনে নিয়ে যান। প্রতিদিন কাজ শেষে সমবয়সীরা গল্প-আড্ডায় মেতে ওঠেন। বিয়ের উপযুক্ত হলেও আরও কিছুকাল তাঁরা অবিবাহিত জীবন কাটাতে চান।

মৌলভীবাজারের নিরালাপুঞ্জিতে যেতে পথে পড়বে গোল মরিচের গাছ। গত ১৯ অক্টোবর তোলা
ছবি : সুমনকুমার দাশ

সরেজমিনে দেখা গেল, পুরো গ্রাম যেন শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি। রাস্তাঘাটে ময়লা-আবর্জনা নেই। প্রতিটি বাড়ির উঠান ঝকঝকে ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সব কটি বাড়ির আঙিনায় হরেক রকমের ফুলগাছ আছে। মোরগ ফুল, পাতা সুন্দরী, রক্তজবাসহ কতশত চেনা-অচেনা বুনো ফুল। ঘরের সামনে-পেছনে টিলাজুড়ে লম্বা লম্বা গাছ বেয়ে পানগাছ লতার মতো পেঁচিয়ে আছে। গাছে একঠেঙি মই রেখে বেয়ে বেয়ে উঁচু মগডালে উঠে পান তুলছেন পুরুষেরা। পাশেই সারি সারি কলা আর সুপারিসহ নানা পাহাড়ি গাছ।

গ্রামে ঘুরতে গিয়ে দেখা হয় রিয়া সুরংয়ের (২১) সঙ্গে। ২০২২ সালে শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন তিনি। এরপর পারিবারিক সমস্যায় আর পড়াশোনা এগোয়নি। চাকরি-বাকরি করার ইচ্ছা নেই তাঁর। বিক্রির জন্য পান প্রস্তুত করার কাজ করেই তাঁর সময় যায়।

কথায় কথায় রিয়া সুরং জানান, এক ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। অন্য বোনেরা বিয়ের পর স্বামী নিয়ে নিজ ঘরেই থাকেন। ইচ্ছা করলে তাঁরা স্বামীর বাড়িতেও যেতে পারবেন। কিন্তু পরিবারের ছোট মেয়ে হওয়ায় রীতি অনুযায়ী তাঁকে বিয়ের পর নিজের ঘরেই থেকে যেতে হবে। চাইলেও স্বামীর বাড়িতে যেতে পারবেন না। বিয়ের পর বরকে তাঁর ঘরে স্থায়ীভাবে উঠিয়ে আনা হবে। মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়া পরিবারে এটাই প্রথা।

গ্রামের ইট বিছানো কাঁচা–পাকা রাস্তা দিয়ে পিঠে পানভর্তি ঝুড়ি আর মুখভর্তি হাসি নিয়ে কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন দুজন ব্যক্তি। হাঁটতে হাঁটতেই তাঁদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। জানালেন, বর্ষাকালে পানগাছ রোপণ করতে হয়। তবে পরিচর্যা করতে হয় সব সময়। প্রতি পানের খাঁচা দেড় থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। উপজেলা সদর থেকে ব্যবসায়ীরা গ্রামে এসে পান সংগ্রহ করেন। পরে জিপগাড়িতে করে তাঁরা পান নিয়ে যান। সেসব পানই শ্রীমঙ্গলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়।

কাজ শেষে মৌলভীবাজারের নিরালাপুঞ্জির রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরছেন পুরুষেরা। গত ১৯ অক্টোবর তোলা
ছবি : সুমনকুমার দাশ

গ্রামবাসী জানান, একসময় আরও দুর্গম জনপদ ছিল নিরালাপুঞ্জি। তখন পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া বিকল্প উপায় ছিল না। এখন দুর্গম হলেও জিপগাড়ি বা মোটরসাইকেলে যাতায়াত করা যায়। অনেক শৌখিন পর্যটক ছবির মতো সুন্দর গ্রামটি দেখতে যান। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে অন্তত দেড় হাজার ফুট উঁচুতে এ গ্রামের অবস্থান। ২০১৬ সালে এ গ্রামে বৈদ্যুতিক সংযোগ স্থাপিত হয়। এ ছাড়া ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে উপজেলা সদরের সঙ্গে গ্রামের সংযোগ সড়কটি তৈরি হয়।

পুঞ্জিবাসীর তথ্যমতে, সংযোগ সড়ক তৈরি হলেও পাহাড়ি উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা রাস্তায় এখনো গ্রামটিতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হয়নি। গ্রামে কয়েকটি মুদিদোকান থাকলেও প্রয়োজনীয় সব পণ্য পাওয়া যায় না। প্রতি সপ্তাহেই উপজেলা সদর থেকে দোকানিরা যান। তাঁরা চাল, ডাল, মাছসহ প্রয়োজনীয় নানা পণ্য ফেরি করে বিক্রি করেন। গ্রামে অসংখ্য কুয়া আছে। ১০ থেকে ১২ হাত খুঁড়ে পানি তোলা হয়। পানির জন্য সেসবই ভরসা। কোনো চিকিৎসক না থাকলেও তিনটি ফার্মেসি আছে। খাসিয়া ছাড়া এখানে গারো, ত্রিপুরা ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ থাকেন। তাঁরা মূলত পানের বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।

নিরালাপুঞ্জিতে আসার পথে গাইড তাজুল ইসলাম মাঝেমধ্যে জিপ থামিয়ে বিভিন্ন জিনিস দেখাচ্ছিলেন। কোনটা পুরুষ আর কোনটা নারী পান, সেটাও দেখিয়ে দেন। রাস্তার পাশে সারি সারি গাছ থেকে পেড়ে কাঁচা গোলমরিচ খেতে দিয়ে বারবার বলছিলেন, ‘ঝাঁজ হলেও খান। শরীরে শক্তি পাইবেন!’ বুনো কলা, লেবু ও আনারসের গুণগান করে তা পরখ করার অনুরোধও করেন।

মৌলভীবাজারের নিরালাপুঞ্জিতে যেতে হয় উঁচুনিচু রাস্তা আর চা-বাগান পেরিয়ে। গত ১৯ অক্টোবর তোলা
ছবি : সুমনকুমার দাশ

শ্রীমঙ্গল ফিরে কথা হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবু তালেবের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিরালাপুঞ্জিতে মোট ২২০টি পরিবার থাকে। জনসংখ্যা ১ হাজার ২০০। মোট ভোটার ৫২৩। শিক্ষার হার ৬০ শতাংশ। গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তিনটি গির্জা আছে। ওই গ্রাম থেকে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তের দূরত্ব সাড়ে তিন কিলোমিটার।

ইউএনও বলেন, গ্রামটিতে কখনো মারামারি হয়নি। এ গ্রামের কোনো বাসিন্দা কখনো কারও বিপক্ষে কোনো মামলাও করেননি। নিজেদের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হলে নিজেরাই সমাধান করে নেন।