ফরিদপুরে বিএনপির সভা পণ্ড হওয়ার যেসব কারণ জানা গেল
ফরিদপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে সঠিক মূল্যায়ন না হওয়া, আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের স্বেচ্ছাচারিতা এবং ‘একলা চলো নীতির’ কারণে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গতকালের মতবিনিময় সভায়। বুধবার বিকেলে জেলার নয়টি উপজেলার নেতাদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে জেলা বিএনপি। নেতা-কর্মীদের বাদানুবাদ, হাতাহাতি ও ভাঙচুরের কারণে সভাটি পণ্ড হয়ে যায়।
জেলা বিএনপির সর্বশেষ ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর। তখন ১৫২ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও জেলার নেতাদের দ্বন্দ্বের কারণে সম্মেলন কিংবা নতুন কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। ১০ বছর পর ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
প্রায় দুই বছর পর ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোদাররেছ আলীকে আহ্বায়ক ও জেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ কে কিবরিয়াকে সদস্যসচিব করে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া ৯ জনকে যুগ্ম আহ্বায়ক ও ২০ জনকে সদস্য করা হয় কমিটিতে।
শুরু থেকেই আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে প্রতিবাদ শুরু করেন কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা। এর মধ্যে ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক আফজাল হোসেন খান, ২ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক সৈয়দ জুলফিকার হোসেন, ৩ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক খন্দকার ফজলুল হক, যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আশরাফ, দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তাঁরা জেলা বিএনপির সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী ছিলেন। আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর তাঁরা বিক্ষোভ করে ঘোষিত কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি দেওয়ার দাবি জানান। ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটামও দিয়েছিলেন তাঁরা। পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ ও বিএনপির ১০ দফা দাবির আন্দোলন শুরু হলে সেই ক্ষোভ চাপা পড়ে যায়।
বর্তমান কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের বিরুদ্ধে কমিটির অন্য নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় না করে নিজেদের মতো স্বেচ্ছাচারী পন্থায় কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি আলফাডাঙ্গা, ভাঙ্গা, সদরপুর পৌরসভা এবং আলফাডাঙ্গা ও সদরপুর উপজেলা শাখার কমিটি গঠন করা হয়। এ নিয়ে প্রতিবাদ উঠলে ২৯ জানুয়ারি বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক এমরান সালেহ ওই পাঁচ কমিটি স্থগিত করেন।
গতকাল প্রতিটি উপজেলার ‘সুপার ফাইভ’ সদস্য নিয়ে জেলা বিএনপির কার্যালয়ে মতবিনিময় সভা আহ্বান করা হয়। সভায় স্থগিত হওয়া কমিটির নেতারাও যোগ দেন। একই সঙ্গে একাধিক যুগ্ম আহ্বায়কসহ জেলা বিএনপির অনেক নেতা সভায় আমন্ত্রণ পাননি। এ খবর পেয়ে যুগ্ম আহ্বায়ক সৈয়দ জুলফিকারের নেতৃত্বে জেলা বিএনপির বিক্ষুব্ধ নেতারা ওই সভায় হাজির হয়ে ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান। একপর্যায়ে বাদানুবাদ, হাতাহাতি, চেয়ার ছোড়াছুড়িসহ আসবাব ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এতে সভাটি পণ্ড হয়ে যায়।
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জুলফিকার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সভার ব্যাপারে যুগ্ম আহ্বায়ক আফজাল হোসেন, খন্দকার ফজলুল হক, দেলোয়ার হোসেনসহ আহ্বায়ক কমিটির সদস্যদের জানানো হয়নি। তাঁরা উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারেন। এ ছাড়া স্থগিত কমিটির নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে কর্মসূচিগুলোতে লোকসমাগম কম হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতারা এলেও ওই দুই নেতার অসহযোগিতা ও একগুঁয়েমির কারণে কর্মসূচিগুলো ‘ফ্লপ’ হচ্ছে।
সভায় বাদানুবাদ ও হট্টগোল করাকে ‘অসাংগঠনিক’ মন্তব্য করে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়া বলেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি পদযাত্রা কর্মসূচি শেষ করে এ বিষয়ে দলের মধ্যে আলোচনা হবে। তাঁদের ক্ষোভ থাকলে তাঁরা তা সাংগঠনিকভাবে উপস্থাপন করলে বেশি শোভন হতো। এ ঘটনায় পদযাত্রা কর্মসূচিতে কোনো প্রভাব পড়বে না দাবি করে তিনি বলেন, কর্মসূচি সফল করার জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
জেলা বিএনপির ৮ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক আজম খান বলেন, দলে থাকলে দলের শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। তারেক রহমান যে কমিটি দিয়েছেন, তার প্রতি অনুগত থাকতে হবে। যাঁরা দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর করেছেন, তাঁরা দলবিরোধী কাজ করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি আগের কমিটির দুই নম্বর সহসভাপতি ছিলাম। আহ্বায়ক কমিটিতে আমাকে আট নম্বরে রাখা হয়েছে। অনেক জুনিয়রকে আমার ওপরে পদ দেওয়া হয়েছে। আমি তো রাগ করিনি। সব কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছি।’
যুবদল নেতা বেনজীর আহমেদ বলেন, বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির নেতারা বিভিন্ন অনিয়ম করে যাচ্ছিলেন। ঘটনার তুলে ধরতে ও প্রতিবাদ জানাতে তাঁরা জুলফিকারের নেতৃত্বে ওই সভায় যান। তাঁদের তৃণমূলের নির্যাতিত নেতা–কর্মীরা ছিলেন। কথাকাটাকাটি থেকে উত্তেজিত হয়ে তৃণমূলের নেতা–কর্মীরা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন। এটি দলের জন্য ঠিক হয়নি। দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। ভবিষতে এ বিষয়ে আরও সতর্ক হতে হবে।