কুমারখালীর এক গ্রামে ১২ দিনে তিনটি ব্যাটারিচালিত ভ্যান চুরি, দিশাহারা পরিবার
‘নিজের জাগা (জমি) নেই। অন্যের বাড়ি থাকি। ভ্যান চালাইয়াই খাতাম। সেটাও চুরি হয়া গেছে। এখন কী খায়ে বাঁচবানে?’ আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর বাসিন্দা গৃহিণী ফাহিমা খাতুন (৪৭)।
তাঁর স্বামী মাসুদ রানা (৫২) বলেন, ‘মাসখানেক আগে ৩৩ হাজার টাকা খরচ করে নতুন ব্যাটারি লাগাইছি ভ্যানে। কিস্তির টাকাও শোধ হয়নি। ভ্যান চালিয়েই চলত স্ত্রী, দুই সন্তানসহ চারজনের সংসার। এখন কী হবে, এসব ভেবেই দিশাহারা।’
মাসুদ ও ফাহিমা দম্পতি উপজেলার যদুবয়রা ইউনিয়নের জোতমোড়া গ্রামের বাসিন্দা। প্রায় ১০ বছর ধরে তাঁরা ওই গ্রামের শহিদ বিশ্বাসের জরাজীর্ণ বাড়িতে থাকেন। তবে গরিব হওয়ায় তাঁদের কাছ থেকে বাড়ির মালিক ভাড়া নেন না। গত শনিবার রাতে তাঁদের উপার্জনের একমাত্র ভ্যানটি চুরি হয়ে গেছে।
কুমারখালী-পান্টি সড়ক ঘেঁষে জোতমোড়া গ্রামের অবস্থান। গতকাল সোমবার গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ টিনশেড মাটির ঘরে মাসুদ ও ফাহিমা দম্পতির বসবাস। ভ্যান চুরির খবর শুনে কয়েকজন প্রতিবেশী এসেছেন। মাসুদের হাতে চুরি যাওয়া ভ্যানটির চার্জার এবং ফাহিমার হাতে কাটা শিকল ও তালা। তাঁদের সামনে রাখা রয়েছে চোরের ফেলে যাওয়া চায়না কাটারটি। চোখে-মুখে হতাশার ছাপ।
মাসুদ রানা বলেন, গত রোববার ভোরে ঘুম ভেঙে দেখেন, ভ্যানটি নেই। পড়ে আছে চার্জার, কাটা শিকল, তালা ও একটি চায়না কাটার যন্ত্র। প্রায় ৮০ হাজার টাকা মূল্যের মোটরচালিত ভ্যানটি রাতের আঁধারে চুরি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও ভ্যানটি পাননি। পরে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জোতমোড়া গ্রামে গরু, ছাগল ও ভ্যান চুরির হিড়িক পড়েছে। গত ১২ দিনে বাড়ি থেকে ৩টি ভ্যান চুরি হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৮ নভেম্বর জোতমোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের মকছেদ মোল্লার ছেলে সুজন আলীর (৩২) প্রায় ৭০ হাজার টাকা মূল্যের ভ্যানটি নিজ বাড়ি থেকে শিকল ও তালা কেটে চুরি হয়েছে। একইভাবে শিকল ও তালা কেটে গ্রামের মৃত আলফাজ বিশ্বাসের ছেলে হেলাল উদ্দিনের ভ্যানটি গত ২৬ নভেম্বর রাতে বাড়ি থেকে চুরির ঘটনা ঘটে। আর গত শনিবার রাতে মাসুদের ভ্যানটি চুরি হয়। উপার্জনের একমাত্র অবলম্বনটি হারিয়ে দিশাহারা চালকেরা।
ক্ষতিগ্রস্ত হেলাল উদ্দিন বলেন,‘ভ্যানটি চালিয়ে যা উপার্জন হতো, তা দিয়েই চলত ছয়জনের সংসার। ভ্যান চুরির পর থেকে উপার্জন বন্ধ আছে। থানায় অভিযোগ দিয়ে বাজারে বাজারে হারানো ভ্যানটির খোঁজ করছি। কীভাবে আবার ভ্যান কিনব, তা ভাবছি এখনো।’
সুজন আলী বলেন, ‘ধারদেনা ও ঋণ নিয়ে ভ্যানটি কিনেছিলাম। ভ্যানে করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভাঙারির ব্যবসা করতাম। এখন বেকার বসে আছি। ১২ দিনের মধ্যে ৩ জনের ভ্যান চুরি হয়েছে। তবে থানায় লিখিত অভিযোগ জানিয়েও চোর ধরা যাচ্ছে না। চুরির আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন লোকজন।’
লিখিত অভিযোগের ঘটনাগুলোর তদন্ত চলছে। জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তার স্বার্থে টহল টিম জোরদার করা হবে।সোলায়মান শেখ, কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
ভ্যান ছাড়াও জোতমোড়া গ্রামে গরু–ছাগল চুরির ঘটনা ঘটেছে। গৃহিণী সুরাইয়া পারভীন বলেন, ‘শাশুড়ি অসুস্থ, ঢাকায় চিকিৎসাধীন। আমি ছেলে নিয়ে স্কুলে গিয়েছিলাম। স্বামী বাড়ির বাইরে ছিলেন। মাত্র ৪০ মিনিটের ব্যবধানে দিনের বেলায় গোয়ালঘর থেকে ২টা বড় খাসি ছাগল চুরি হয়ে গেল, যার দাম প্রায় ৩০ হাজার টাকা।’
যদুবয়রা ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা আশরাফ আলীর বাড়ি জোতমোড়া গ্রামের পশ্চিমপাড়ায়। তিনি বলেন, মাসখানেক আগে তাঁর বাবা সিরাজুলের প্রায় এক লাখ টাকা মূল্যের একটি গরুটি চুরি হয়েছে। থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো লাভ হয়নি।
যদুবয়রা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের বাড়ি জোতমোড়া গ্রামে। তিনি বলেন, প্রায়ই গ্রামে চুরির ঘটনা ঘটছে। এতে মানুষ চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে। চুরি ঠেকাতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোলায়মান শেখ বলেন, লিখিত অভিযোগের ঘটনাগুলোর তদন্ত চলছে। জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তার স্বার্থে টহল টিম জোরদার করা হবে। সর্বসাধারণের সমন্বয়ে সব ধরনের অপরাধ নির্মূলে পরিকল্পিতভাবে কাজ করা হবে।