দারিদ্র্যের কারণে অষ্টম শ্রেণিতে থাকতে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ইয়াছিনের। প্রবল ইচ্ছাশক্তির বলে একসময় টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগায় সে। অভাবের কারণে প্রতিদিন তিন কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেত মাহমুদা। লেখাপড়ার জন্য অন্যের দোকানে শ্রমিকের কাজ করেছে হাসিবুল। আর মায়ের অনুপ্রেরণায় চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে শারমিন।
অদম্য মেধাবী এই শিক্ষার্থীরা এবার দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে তারা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আর্থিক অনটনে উচ্চশিক্ষা নিয়ে তাদের মনে আছে সংশয়।
টিউশনি করে পড়েছে ইয়াছিন
সংসারে অভাব-অনটন নিত্যদিনের সঙ্গী। অষ্টম শ্রেণিতে থাকতে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় ইয়াছিন মিরাজের। কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর শিক্ষকদের সহযোগিতায় আবার পড়াশোনা শুরু করে সে। এরপর টিউশনি করে নিজের পড়াশোনা চালায়। ইয়াছিন লক্ষ্মীপুরের রায়পুর এলএম পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের কারিগরি শাখা থেকে এসএসসি পাস করেছে।
ইয়াছিনের বাড়ি জেলার রায়পুর উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের গাজীনগর গ্রামে। ১৫ বছর আগে তার বাবা আহছান উল্যা মারা যান। এক বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে সে সবার ছোট। ইয়াছিন মিরাজ জানায়, ভাই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় একসময় পড়াশোনা বন্ধ যায়। পরে বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাকে পড়াশোনায় উৎসাহ দেন। সে বলে, ‘মেজ ভাই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করে ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারেন না। আগামী দিনের পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’
রায়পুর এলএম পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহাবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ইয়াছিনকে আমরা সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছি।’
দারিদ্র্যের সঙ্গে মাহমুদার লড়াই
মাহমুদার বাবা রফিকুল ইসলাম পেশায় একজন পোশাকশ্রমিক। করোনা মহামারির সময় চাকরি খুইয়ে বেকার হয়ে পড়েন। অভাবের সংসারে মেয়ের পড়ালেখার খরচ দিতে পারতেন না। বাধ্য হয়ে মাহমুদা প্রতিদিন তিন কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেত। অদম্য মেধাবী মাহমুদা এবার ধুনট সরকারি নইম উদ্দীন পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
মাহমুদাদের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলা সদর ইউনিয়নের পারধুনট গ্রামে। মাহমুদার ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মাহমুদা জানায়, বাবা স্বল্প বেতনে পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। করোনার সময় বাবার চাকরি চলে গেলে তাদের দুই ভাইবোনের লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়। তবু সে থেমে থাকেনি। ধুনট সরকারি নইম উদ্দীন পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তফিজ উদ্দীন বলেন, সবার সহযোগিতা পেলে সে ভালো কিছু করবে।
ভর্তি নিয়ে দুশ্চিন্তায় হাসিবুল
বন্ধুদের সবাই যখন কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে, কলেজে ভর্তির টাকা জোগাড় করার জন্য ব্যস্ত তখন দোকানে বিক্রয় সহকারীর কাজ নিয়েছে হাসিবুল ইসলাম। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ধানঘরা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে।
হাসিবুল ইসলাম উপজেলার ধানগড়া ইউনিয়নের আবুদিয়া গ্রামের আবদুল লতিফ ও আসমা খাতুন দম্পতির বড় ছেলে। ধানগড়া এলাকার একটি জর্দা কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন হাসিবুলের বাবা আবদুল লতিফ। তিনি বলেন, ‘যে টাকা রোজগার করি, তা দিয়ে সংসার চালানোই কঠিন। ছেলেদের পড়ালেখার খরচ দেব কীভাবে?’ মা আসমা খাতুন বলেন, ‘থাকার মধ্যে আছে বাড়ির জমিটুকু। বাড়িতে বিদ্যুৎও নেই। তবু ছেলেটা পড়ালেখা করে ভালো ফল করেছে।’
চিকিৎসক হতে চায় শারমিন
জন্মের পরপরই বাবাকে হারায় শারমিন। সংসার ও মেয়ের পড়ালেখার খরচ জোগাতে শারমিনের মা পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। মায়ের অনুপ্রেরণায় পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে শারমিন আক্তার। সে এবার বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ছাতিয়ানগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।
শারমিন আদমদীঘি উপজেলার ছাতিয়ানগ্রাম ইউনিয়নের অন্তাহার গ্রামের মৃত সাজু হোসেন ও শিখা বানু দম্পতির মেয়ে। শারমিন জানায়, প্রাইভেট বা কোচিং করতে না পারলে সে বাড়িতে নিজে নিজে পড়েছে। স্কুলের শিক্ষকেরা তাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। ভবিষ্যতে সে চিকিৎসক হতে চায়। ছাতিয়ানগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইছাহাক আলী বলেন, অর্থসহায়তা পেলে মেয়েটি অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন মাসুদ রানা, ধুনট, বগুড়া; খায়রুল ইসলাম, আদমদীঘি, বগুড়া; এ বি এম রিপন, লক্ষ্মীপুর; সাজেদুল আলম, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ]