ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি নেতার মামলায় আওয়ামী লীগের মৃত নেতাও আসামি
ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা ও দলীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ঠাকুরগাঁও সদর থানায় গত বুধবার রাতে একটি মামলা হয়েছে। জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্ট ঠাকুরগাঁও জেলার সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ কুমার কুন্ডু এ মামলার বাদী। মামলায় প্রায় সাত বছর আগে মারা যাওয়া এক আওয়ামী লীগ নেতার নামসহ নানা অসংগতি ও গণহারে আসামি করা নিয়ে আলোচনা চলছে।
মামলায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক পৌর মেয়র, সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাসহ ২৯৪ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করেছেন বাদী।
এজাহারে বলা হয়, গত বছরের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ঠাকুরগাঁও শহরের চৌরাস্তায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার রায়ের নেতৃত্বে দলের নেতা-কর্মীরা লোহার রড, ধারালো ছুরি, রামদা, চায়নিজ কুড়াল, পিস্তল, শটগান, বোমা-বারুদ নিয়ে হামলা চালান। তাঁরা আন্দোলনের পক্ষে থাকা ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ককটেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। এর এক পর্যায়ে হামলাকারীরা শটগান ও পিস্তলের গুলি ছোড়েন। এতে ছয়জন আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ছুরি, লোহার রড, রামদা, চায়নিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে আন্দোলনকারীদের আহত করেন। পরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে গিয়ে ককটেল বিস্ফোরণ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এলাকা দখলে নেন। সেখানে পেট্রল ছিটিয়ে বিএনপির কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। আগুনে কার্যালয়ের ভেতরে থাকা পাঁচটি ল্যাপটপ, দুটি টেলিভিশন, একটি ফ্রিজ, তিনটি এসি, চেয়ার-টেবিলসহ কাগজপত্র পুড়ে যায়।
মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার রায়, সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দ্রৌপদী আগরওয়ালা, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সন্তোষ আগরওয়ালা, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সভাপতি আবদুল মজিদ, সাবেক পৌর মেয়র আঞ্জুমান আরা বেগম, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হক প্রমুখ। এ ছাড়া বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর কুমার গুপ্ত ও বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার ঘোষকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।
মামলায় আসামির তালিকায় ২১২ নম্বরে রয়েছে শহরের বাজারপাড়ার বাসিন্দা আব্দুল মান্নানের ছেলে বাপ্পীর (২৯) নাম। বাপ্পীর পুরো নাম শরিফুল হাসান। তিনি ঠাকুরগাঁও পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। প্রায় সাত বছর আগে মারা গেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বাজারপাড়ায় গিয়ে শরিফুল হাসানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, মো. বাপ্পীর পুরো নাম শরিফুল হাসান। এ সময় তাঁরা শরিফুল হাসানের মৃত্যুসনদ দেখান। সেখানে ২০১৮ সালের ২৯ এপ্রিল দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মৃত্যুর কারণ দেখানো হয়েছে ‘ব্রেন স্ট্রোক’।
শরিফুল হাসানের বড় ভাই সাইদুর হাসান বলেন, ‘একজন মৃত ব্যক্তি কীভাবে হামলা চালাতে পারে? সে সেই কবে মারা গেছে। ৪ আগস্টের হামলার ঘটনায় মামলার মৃত ব্যক্তি কীভাবে আসামি হতে পারে, আমার বুঝে আসে না।’
আরও যত অসংগতি
মামলার আসামির তালিকার ২৭ ও ২০৯ নম্বরে একই ব্যক্তির নাম দেওয়া হয়েছে। ওই ব্যক্তির নাম বাবলুর রহমান। তিনি ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক। ঠাকুরগাঁও জেলা ট্রাক, ট্যাংকলরি, কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপ শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানার নামও দুবার (১১৬ ও ২২৫ নম্বরে) পাওয়া গেছে।
এছাড়া মামলায় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফখরুল ইসলাম (১০৫ ও ২১৮) ও ৯নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদের (১০৪ ও ২৬১) নামও দুবার রয়েছে।
মামলায় রয়েছে এক দম্পতি ও তাঁদের দুই সন্তানের নাম। ২৫ নম্বরে রয়েছে কামিনী সরকারের ছেলে লাবু সরকারের নাম। ভূল্লী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক তিনি। ২৬৮ নম্বরে রয়েছে শিউলি ঘোষের নাম। শিউলি ঘোষ পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে চাকরি করেন। আসামির তালিকায় ২৬৯ নম্বরে রয়েছে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রের নাম। সে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। মামলার এজাহারে ওই ছাত্রের বয়স ২০ বছর দেখানো হলেও আসলে তার বয়স ১৫ বছর বলে দাবি পরিবারের। ৪ আগস্টের হামলার সময় সে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সক্রিয় ছিল বলে জানিয়েছে সহপাঠীরা।
২৮৩ নম্বর রয়েছে ওই ছাত্রের বড় বোনের নাম। তিনি গত বছর এইচএসসি পাস করেছেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় রয়েছেন। এ ছাড়া ২৫৬ নম্বরে গৃহবধূ সোমা দত্তের নাম দেওয়া হয়েছে। তাঁর পরিবারের দাবি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় তাঁর নাম দেওয়া হয়েছে। তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন।
এ বিষয়ে লাবু সরকার বলেন, ‘হয়রানির জন্যই গোটা পরিবারকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। আমরা মামলাটির সঠিক তদন্ত চাই।’
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস আলী বলেন, ‘লাবু সরকার একসময় বিএনপি করতেন। তিনি বালিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। বিদ্যালয়ের চাকরি করতে গিয়ে তাঁকে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ওঠবস করতে হয়েছে। তবে তিনি কোনো দিন আওয়ামী লীগ করতেন না। মামলার যিনি বাদী, তাঁর শ্বশুরবাড়ি লাবু সরকারের বাড়ির পাশে। তাঁদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণেই লাবুর পরিবারকে মামলার আসামি করা হয়েছে। শুধু লাবুর পরিবার নয়, তাঁদের আরও কয়েকজন আত্মীয়স্বজনকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। এভাবে মামলার আসামি করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
এ বিষয়ে মামলার বাদী সত্যজিৎ কুমার কুন্ডু বলেন, ‘আমি নই, মামলাটি দল করেছে। দলের লোকজন মামলা প্রস্তুত করেছে, আমি শুধু স্বাক্ষর করেছি। স্বাক্ষর করেই ঢাকা চলে এসেছি।’ মামলার এজাহারে অসংগতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমিও শুনলাম।’
ঠাকুরগাঁও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুর রহমান বলেন, ‘মামলাটি তদন্ত করে দেখা হবে। তদন্তেই সব বের হয়ে আসবে। এতে মৃত কোনো ব্যক্তি আসামি হলে তাঁদের নাম বাদ যাবে। একটি ঘটনার বিষয়ে মামলা হলে সেই ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসে পুলিশের তদন্তে। আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করব।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ঠাকুরগাঁওয়ের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে বলেন, এখন রাজনৈতিক মামলাগুলো উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়। মামলা করতে হবে, সেই জন্যই করা হচ্ছে। মামলায় দেখা যায় ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হচ্ছে। গণহারে মামলা করলে তো যাচাই-বাছাই করার সুযোগ থাকে না। অযথা কোনো মানুষকে হয়রানির জন্য মামলা করা অবশ্যই দুঃখজনক। মৃত মানুষকে আসামি করার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।