ধামরাইয়ে বুচাই পাগলার মাজার ভাঙচুর, ভবনে অগ্নিসংযোগ
ঢাকার ধামরাইয়ে একটি মাজারে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া মাজার–সংলগ্ন প্রশাসনিক কার্যালয়, ভক্তদের থাকার ঘর ভাঙচুর ও অতিথিদের থাকার ভবনের কয়েকটি কক্ষে অগ্নিসংযোগ করেছে হামলাকারীরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে মাজারটি ‘আধ্যাত্মিক সাধক বুচাই পাগলার মাজার’ হিসেবে পরিচিত।
উপজেলার সানোড়া ইউনিয়নের বাটুলিয়া এলাকায় গতকাল বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটেছে।
মাজারপন্থী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাজারের আশপাশের এলাকার বেশ কয়েকটি মাদ্রাসার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমামসহ আলেম-ওলামারা ভেকু দিয়ে মাজারটি ভাঙচুর করেন। হামলাকারীরা মাজারের প্রশাসনিক কার্যালয় ও ভক্তদের থাকার ঘর ভাঙচুর এবং অতিথিদের থাকার ভবনের কয়েকটি কক্ষে অগ্নিসংযোগ করেছেন।
ভাঙচুরকারীদের দাবি, মাজারটি ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড ও মাদক সেবনের আখড়ায় পরিণত হওয়ায় তাঁরা এটি ধ্বংস করেছেন। বুচাই পাগলা সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কোনো আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন না।
তবে মাজারপন্থীদের দাবি, এই মাজারে শরিয়াহবিরোধী কাজকর্ম হতো না। মাজারে মাদক নিষিদ্ধ ছিল। ভক্তদের কাছ থেকে পাওয়া মাজারের টাকায় একটি মসজিদ পরিচালনা, মাদ্রাসায় অর্থ দেওয়াসহ অসহায় মানুষদের সহায়তা করা হয়। মাজারে হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, প্রতিবছর মাজারকে কেন্দ্র করে আয়োজিত মেলা চলাকালে ভক্তদের অনেকে মাজারের আশপাশের ঘরে গানবাজনা করতেন। সেখানে অনেকে গাঁজা সেবন করতেন। বিষয়টি নিয়ে আপত্তি থাকলেও মাজারের বিষয়ে কারও কোনো অভিযোগ ছিল না। মাদক বন্ধ করা যেত। মাজার ভাঙা ঠিক হয়নি।
ধামরাইয়ের বাটুলিয়া এলাকায় কালামপুর-সাটুরিয়া আঞ্চলিক সড়কের পাশে বাটুলিয়া কবরস্থানের সামনের দিকে মাজারটির অবস্থান। আজ বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, মাজারের সামনের দিকের অংশ পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে প্রাচীর এবং ইট ও সিমেন্ট দিয়ে বানানো টাইলস করা কবরটি। পাশের টিনের প্রশাসনিক ঘরটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাজারের অদূরে টিনশেড ও পাকা দেয়ালে ঘেরা ভক্তদের থাকার পাগল ধামটির সামনের লোহার ফটক ও পিলার ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ছাড়া মাজারকে কেন্দ্র করে বাৎসরিক মেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসা অতিথিদের থাকার পাকা ভবনের বিভিন্ন কক্ষে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আসবাব। ভাঙচুরের খবর পেয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মাজারটি দেখতে এসেছেন অনেকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বুচাই পাগলার মাজারের সামনে আশপাশের এলাকার বেশ কয়েকটি মাদ্রাসার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমামসহ আলেম-ওলামারা জড়ো হন। পরে তাঁরা ভেকু দিয়ে মাজার ভাঙচুর করেন। এ ছাড়া তাঁরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে মাজারের প্রশাসনিক ঘর, ভক্তদের থাকার ঘর, অতিথিদের থাকার পাকা ভবন ভাঙচুর করেন। বেলা আড়াইটার দিকে খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসে ভাঙচুরকারীদের বোঝালে তাঁরা চলে যান।
একটি ভিডিওতে ভাঙচুরে অংশ নেওয়া কুশুরা দক্ষিণ কান্টাহাটি মসজিদের ইমাম মাওলানা মনিরুল ইসলামকে বলতে শোনা যায়, ‘ছোট থেকে দেখছি, এখানে শিরক–বেদাতি কাজকর্ম চলছিল। এগুলো কোনোভাবেই আমরা প্রতিরোধ করতে পারছিলাম না। আলহামদুলিল্লাহ, এখন প্রতিরোধ করার সময় হয়েছে। এখন যদি বসে থাকি, তবে কেয়ামতের ময়দানে হিসাব দিতে হবে। যে কারণে আমরা ধামরাই থানার সব ওলামায়ে কেরাম একত্র হয়ে, বিভিন্ন সংগঠন থেকে সবাই একত্র হয়ে এসব বেদাতি কাজকর্ম বন্ধ করার জন্য এ পদক্ষেপ নিয়েছি।’
ওই ভিডিওতে ভাঙচুরে অংশ নেওয়া আবুল কাশেম নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘এখানে মদ, গাঁজা সেবনসহ নানা অনৈতিক কাজ হতো। তবে জনগণ প্রতিবাদ করতে পারেনি। কালামপুর ও আশপাশের তৌহিদি জনতা সবাই একত্র হয়ে এটি ধ্বংস করেছে।’
তবে মাজারপন্থীরা এসব অভিযোগ নাকচ করে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা দাবি করেছেন, এই মাজারে শরিয়াহবিরোধী কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা হতো। মাজারে সিজদা করতে দেওয়া হতো না। মাজারের দানবাক্স সপ্তাহে এক দিন জনসমক্ষে খোলা হতো। দানের অর্থে একটি মসজিদ তৈরি করা হয়েছে। ইমামের বেতন দেওয়া হয় মাজারে দেওয়া ভক্তদের টাকায়। এ ছাড়া অসহায়–দরিদ্রদের আর্থিক সহযোগিতা, মাদ্রাসায় আর্থিক সহায়তাসহ মানুষের কল্যাণে ভক্তদের দেওয়া টাকা ব্যয় করা হতো।
স্থানীয় বাসিন্দা তারা মিয়া বলেন, ‘বুচাই পাগলা কখনো কারও ক্ষতি করে নাই। কেউ কিছু দিতে চাইলে শুধু যাকে পছন্দ হইত, তার কাছ থেকেই নিত। মাজার ভাঙা ঠিক হয় নাই।’
মাজারের খাদেম পরিচয় দেওয়া মো. দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা মুসলমান হয়ে কবর ভাঙল কীভাবে? তাদের যদি ভালো না লাগত, তাহলে বলত মাজার বন্ধ রাখতে। এলাকার কেউ বলতে পারবে না মাজারে কোনো ধরনের বেদাতি কাজ হয়।’
মাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন দুলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাজারটি ভাঙা ঠিক হয়নি। যাঁরা ভেঙেছেন, তাঁরা ভেবেছেন মাজারে সিজদা দেওয়াসহ নানা বেদাতি কাজ হয়। এগুলোর কিছুই হয় না। কেউ সিজদা দিতে চাইলে আমরা নিষেধ করি। হামলাকারীরা মাজারপূজা হয়, এমন ভুল ধারণা থেকে মাজারটি ভাঙচুর করেছেন।’
সানোড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মো. তিতুমীর হোসেন বলেন, ‘অতর্কিত লোকজন এসে মাজার ভাঙচুর করেছে। ইউএনও স্যারের ফোন পেয়ে দুজন চৌকিদার নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। এরপর সেনাবাহিনী এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।’
ধামরাই উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রশান্ত বৈদ্য বলেন, ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গেলে ভাঙচুরকারীরা কিছু দাবিদাওয়া জানিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আগামী মঙ্গলবার বৈঠক করবেন।
ধামরাই উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা জানান, বাটুলিয়া এলাকার বাসিন্দা ছিলেন বুচাই পাগলা। কিশোর বয়সেই তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তবে তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিক নানা গুণ ছিল। এ কারণে ধীরে ধীরে তাঁর ভক্ত-অনুসারী তৈরি হয়। ২০০০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর পর বাটুলিয়ার সড়কের পাশে কবরস্থানে সামনের দিকে তাঁকে দাফন করা হয়। পরে ওই কবর ঘিরে মাজার গড়ে ওঠে। প্রতিবছর সেখানে ওরস ও মাসব্যাপী মেলা আয়োজন করা হয়। বাউলগানসহ নানা আয়োজন থাকে সে মেলায়।