ঘরে–বাইরে, শ্রেণিকক্ষে জ্বলে উঠছে আগুন
কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামের কলমা ইউনিয়নের কাকুরিয়া গ্রামের গৃহবধূ রিনা রানী দাস মাঠে শুকাতে দেওয়া কাপড় আনতে যান। গিয়ে দেখেন, কাপড়ে আগুন জ্বলছে। কীভাবে কাপড়ে আগুন লাগল, সেটা রহস্যই থেকে গেছে রিনার কাছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সূর্যাস্তের আগমুহূর্তে ঘটনাটি ঘটে। এর পর থেকে গত ২৯ মার্চ পর্যন্ত কাকুরিয়া গ্রামের ঘরে-বাইরে বেশ কিছু স্থানে আগুন জ্বলে ওঠার ঘটনা ঘটেছে।
ঘর, খড়ের গাদা, লেপ-তোশক, স্কুলের শ্রেণিকক্ষ, স্কুল ব্যাগ, মশারি কিংবা গোয়ালঘরে এসব আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব আগুন লাগার উৎস অজানা। আগুনের সূত্রপাত কীভাবে, সেটাও খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ।
কাকুরিয়া গ্রামে ভোটারসংখ্যা প্রায় ৭০০, পরিবারসংখ্যা ১৪৫। শিক্ষার হার কম। বর্ষায় গ্রামটির চারদিকে পানি থাকে। পেশায় গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কৃষক। তবে তাঁরা বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। গ্রামের প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
গ্রামবাসীর ধারণা, অজ্ঞাত কারণে আগুনের ঘটনা ঘটছে। তাই জানমাল রক্ষায় এরই মধ্যে সমবেতভাবে পূজাও করা হচ্ছে। সাধক এনে পড়ানো হচ্ছে তন্ত্রমন্ত্র। দিনে কেউ ঘর ছেড়ে যাচ্ছেন না। রাতে বসানো হয়েছে পাহারা।
তবে এ বিষয়ে ভৈরবের রফিকুল ইসলাম মহিলা কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রধান আজিজুল হক ভূঁইয়া বলেন, হাওর অঞ্চলের বসতি বর্ষায় পানিবেষ্টিত। এ কারণে বাড়িঘরের চারপাশে কচুরিপানা থাকে। কচুরিপানা থেকে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। এই গ্যাসের প্রভাবে আগুন জ্বলে উঠতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আগুন এমনিতেই জ্বলে উঠবে না। আগুনের অন্য কোনো উৎস লাগবে। তবে যদি ওই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ জোনাকি পোকা থাকে, তাহলে ফসফরাস গ্যাস উৎপন্ন হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে ফসফরাস গ্যাস মিথেন গ্যাসের সঙ্গে মিশে এমনিতেই আগুন তৈরি করতে পারে। অষ্টগ্রামের ঘটনার সঙ্গে এই দুটির যেকোনো একটির প্রভাব থাকতে পারে।
আগুনের ঘটনায় উপজেলা প্রশাসন ও থানা-পুলিশ বিচলিত। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় কারিগরি দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে উপজেলা প্রশাসন ২৯ মার্চ জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি লিখেছে। এরই মধ্যে গত রোববার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হারুন-অর-রশিদ একটি দল নিয়ে কাকুরিয়া গ্রাম পরিদর্শন করেন। ইউএনও হারুন-অর-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগুন লাগছে। কিন্তু কেন লাগছে, তা জানি না। আগুনের অজানা উৎস বের করতে টেকনিক্যাল টিম চেয়ে ডিসি স্যারের কাছে চিঠি লিখেছি।’
অষ্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস দলের সদস্যরাও এরই মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আগুনের উৎসের সন্ধান করতে পারেননি। অষ্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের ইনচার্জ কবির আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘চেষ্টা করলাম। কিন্তু সূত্র পেলাম না।’
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি আগুনের ঘটনার সময়কাল সূর্যোদয়ের পর ও সূর্যাস্তের আগে। বেশির ভাগ আগুন লেগেছে মশারিতে। ঘরে যখন কেউ থাকে না, তখনই আগুন জ্বলে উঠছে। চোখে পড়ামাত্র স্থানীয় উদ্যোগে সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে। এ অবস্থায় রাতে লোকজন পালা করে ঘুমান। দিনের বেলায় ঘর মানুষশূন্য রাখা হয় না। হাওরে এখন বোরো মৌসুম। মাঠ ভরা ধান। কয়েক দিন পর ধান কাটা শুরু হবে। এমন সময় কৃষকেরা মাঠে না গিয়ে বাড়ি আগলে রাখতেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন।
সর্বশেষ ২৯ মার্চ আগুন জ্বলেছে সরকারি কাকুরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি কক্ষে। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ননী গোপাল দাস বলেন, ‘তাজ্জব ব্যাপার। আমরা সবাই আছি। এর মধ্যে দুটি কক্ষে আগুন দেখি। একটি কক্ষে বই ছিল। অপরটি শ্রেণিকক্ষ। তখন কক্ষে কেউ ছিল না।’
বিদ্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কয়েক দিন আগেও বিদ্যালয়টির চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আনু দাসের ব্যাগে আগুন জ্বলে ওঠে। এ ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। এখন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমে গেছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে গ্রামটির বাসিন্দা জয়বাসী দাস, হরকিশোর দাস, ফনিন্দ্র দাস, নরেশ দাস, পরিমল দাস, সুষেন দাস, ব্রজলাল দাস, সুকুমার দাস, অধীর দাস, রবীন্দ্র দাস, অজিত দাস, রামেশ্বর দাস, অরুণ দাস, সুশীল দাস, শ্রীকৃষ্ণ দাসসহ আরও কয়েকটি পরিবারের বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
জয়বাসী দাস জানালেন, তাঁর ঘরে আগুন জ্বলে ওঠে ১০ দিন আগে। তখন বিকেল সাড়ে ৪টা। আগুনে একটি ঘর পুড়ে যায়। ক্ষতি হয় দেড় লাখ টাকার।
সুষেণ দাস বলেন, এক সপ্তাহ আগে বিকেলে তাঁর ঘরের মশারিতে প্রথমে আগুন জ্বলে। মশারি খাটের এক পাশে রাখা ছিল। ঘরে কেউ ছিল না। আগুন নিভিয়ে মশারি বাইরে রাখা হয়। পরদিন ওই মশারিতে আবার আগুন জ্বলে। এর পরদিন আগুন জ্বলে গোয়ালঘরে। পৃথক তিন ঘটনায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
রসিকতা করে পরিমল দাস বলেন, বেশির ভাগ আগুন মশারিতে জ্বলেছে। তাঁর ঘরেও মশারিতে আগুন জ্বলেছে।
এমন অবস্থায় বিচলিত হয়ে পড়েছেন কলমা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাধাকৃষ্ণ দাস। তাঁর বাড়িও একই গ্রামে। রাধাকৃষ্ণ বলেন, ‘এক মাস ধরে আগুনের লগেই আছি। খাওয়া নাই, নাওয়া নাই, ঘুম নাই। আগুন, আগুন আর আগুন।’
কেন এমনটা ঘটছে, এমন প্রশ্নের জবাবে ইউপি রাধাকৃষ্ণ দাস চেয়ারম্যান বলেন, ‘কেউ জানে না, আমিও জানি না। তবে এইডা জানি আগুন জ্বলছে। পূজা, তন্ত্রমন্ত্র দিয়েও কাম হইতাছে না।’
একের পর এক আগুনের ঘটনা প্রাকৃতিক নাকি মনুষ্যসৃষ্ট, তা জানার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোর্শেদ জামান।