বন্যার দুই সপ্তাহ পরও ঘর তুলতে পারেননি তাঁরা

বন্যায় পানি ধসে পড়েছে ঘর। ছবিটি খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ধনীরাম পাড়া থেকে তোলাছবি- প্রথম আলো

দুই সপ্তাহ ধরে পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে ছাপরা ঘরে দিন কাটাচ্ছেন সমীরণ ত্রিপুরা। গত ২১ আগস্ট বন্যায় বিধ্বস্ত হয়েছে তাঁর ঘর। ভেসে গেছে বাড়ির সব জিনিসপত্র আর গবাদিপশু। নষ্ট হয়েছে আয়ের একমাত্র উৎস সবজি আর আমন ধানের খেত।

সমীরণ ত্রিপুরার বাড়ি মাটিরাঙ্গা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ধনিরামপাড়ায়। সমীরণ ত্রিপুরা সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। এখন ঘর তুলবেন কীভাবে, ছোট ছেলেমেয়েদের ত্রাণের চাল শেষ হলে কী খেতে দেবেন, এই চিন্তায় আছেন। ১৪ দিনে তিনি পেয়েছেন ৩০ কেজি চালসহ কিছু খাদ্যসামগ্রী আর ঘর ওঠানোর জন্য ৫ হাজার টাকা।

সমীরণ ত্রিপুরা বলেন, কখনো তাঁদের এলাকায় এভাবে পানি উঠতে দেখেননি। গত ২১ আগস্ট কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফেনী নদীর আর পাড়ার পাশে ছোট ছোট দুটি ছড়ার পানি বেড়ে যায়। পানির স্রোত এতই বেড়ে যায় যে আধঘণ্টার মধ্যে পাড়ার সবার ঘরই ডুবে যায়। জীবন বাঁচাতে তিনি আর তাঁর স্ত্রী বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে এক পরিত্যক্ত জুম ঘরে আশ্রয় নেন। পরদিন ভোরে এসে দেখেন পাড়ার অধিকাংশ বাড়ি বিধ্বস্ত। আগে পাড়ার লোকজন সবকিছুতে একে অপরকে সহযোগিতা করত। এখন সবার একই অবস্থা। কে কাকে সহযোগিতা করবে।

শুধু সমীরণ ত্রিপুরা নয়, তাঁর মতো খাগড়াছড়ি জেলায় আছে কয়েক শ পরিবার। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মাটিরাঙ্গা উপজেলার সদর ইউনিয়নের দুর্গম এলাকায় ব্রজেন কার্বারিপাড়ার ২৫ পরিবার, ধনিরামপাড়ায় ১২ পরিবার আর যাদব বৈষ্ণবপাড়ায় ২০টি পরিবার।

বন্যায় পানিতে নষ্ট হয়েছে ধানের জমি। ছবিটি মাটিরাঙ্গা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ধনীরাম পাড়া থেকে তোলা
প্রথম আলো

বন্যার দুই সপ্তাহ হয়ে গেলেও অনেক পরিবার এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এখনো অনেকে আশ্রয়ে আছেন স্বজনদের বাড়িতে। কেউ কেউ কোনোমতে ছাপরা ঘর বানিয়ে বসবাস করছেন পরিবার নিয়ে।

ধনিরামপাড়ার লোকজন বলেন, তাঁদের সবার বাড়িতে পানি উঠেছে। কারও বাড়ি পুরোপুরি ডুবে যায়, কারও বাড়ি অর্ধেক। ফেনী নদীর পারে নিচু এলাকায় পাড়াটির অবস্থান হলেও এই প্রথম বন্যা হয়। বন্যা সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা না থাকায় তাঁরা অতিরিক্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দুর্গম এবং নেটওয়ার্কের বাইরে হওয়ায় তাদের কাছে পৌঁছায়নি তেমন কোনো ত্রাণসামগ্রীও। তা ছাড়া তাঁদের পাড়াটি মাটিরাঙ্গা সদর উপজেলায় হলেও যোগাযোগ দুর্গম। পাড়ায় যাতায়াতের রাস্তা নেই। গাড়ি দিয়ে পাড়ায় যেতে হলে প্রায় ৬০ কিলোমিটার ঘুরে গুইমারা উপজেলা পাড় হয়ে রামগড় উপজেলার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

গতকাল মঙ্গলবার ধনিরামপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ঘেঁষা ফেনী নদীর পারে সমতল এলাকায় ছোট একটি পাড়া। চারদিকে এখনো বন্যার ক্ষতির চিহ্ন। ভেঙে যাওয়া কয়েকটি ঘর এখনো পড়ে আছে। পাড়ার সবাই কোনোমতে বেড়া আর টিন দিয়ে ছাপরা বানিয়ে দিন পার করছেন। কেউ নতুনভাবে ঘর তুলতে শুরু করেছেন, কেউ ঘর মেরামত করছেন। তবে অনেকেই এখনো বাড়ি সংস্কারে হাত দিতে পারেননি। নতুনভাবে ঘর তুলবেন কিংবা মেরামত করবেন সে সামর্থ্যও তাঁদের নেই। ধানখেতগুলোর ওপর এখনো কয়েক ফুট পলির আস্তরণ।

ব্রজেন কার্বারিপাড়ার কমলকৃষ্ণ ত্রিপুরারও (৫২) একই অবস্থা। পরিবারের আটজন সদস্য আছেন অন্যের জুমঘরে। তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে টিনের ছাউনি দিয়ে পাঁচ কক্ষের একটি মাটির ঘর তুলেছি পাঁচ বছর আগে। দুই বছর হলো ঘরের ফ্লোর পাকা করেছি। এ বছর বৈসুর (চৈত্রসংক্রান্তি) আগে এক জোড়া গরু বিক্রি করে ঘরের ফার্নিচার, টেলিভিশন আর সোলার প্যানেল কিনেছিলাম। হঠাৎ করে ফেনী নদী আর ছোট ছড়ার পানি বেড়ে বাড়ির উঠানে পানি আসে। পানির¯স্রোত দেখে ৮০ বছরের বৃদ্ধ মাকে পাশের পাড়ায় নিরাপদ স্থানে রেখে এসে দেখি আধঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি ডুবে গেছে। বের করতে পারিনি কোনো কিছুই। নতুন ভাবে ঘর ওঠানো তো দূরের কথা, সহযোগিতা না পেলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।’

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, বন্যাকবলিত প্রতিটি পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর নাম মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।