যশোরের চৌগাছা থানার ওসির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি-নির্যাতনের নানা অভিযোগ, প্রত্যাহারের পর তদন্ত কমিটি

পায়েল হোসেন

যশোরের চৌগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পায়েল হোসেনের বিরুদ্ধে বাংলোবাড়িতে আটকে লোকজনকে নির্যাতন, মামলার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি, নারীকে নিজ বাসায় নিয়ে যৌন নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার দেড় মাসের মধ্যে তাঁর ‘বিতর্কিত’ কর্মকাণ্ডে বিব্রত পুলিশ প্রশাসন।

সর্বশেষ নারী কেলেঙ্কারির কয়েকটি অডিও ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর আজ রোববার তাঁকে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে অভিযোগ তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) রুহুল আমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

ছড়িয়ে পড়া অডিওগুলোতে ওসি পায়েলের কণ্ঠসদৃশ এক ব্যক্তিকে এক নারীর সঙ্গে অশালীন কথাবার্তা বলতে শোনা যায়। ৫ মিনিট ১৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ওসি পায়েল কখনো অন্য একটি মুঠোফোনে কথা বলছেন। কখনো হাসতে হাসতে ওই নারীকে বিভিন্নভাবে অশালীন ইঙ্গিত দিচ্ছেন। একপর্যায়ে নিজের বস্ত্রহীন পুরো শরীর প্রদর্শন করতেও দেখা যায়।

এ বিষয়ে ওই নারীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি সাড়া দেননি। অভিযোগের বিষয়ে ওসি পায়েল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবু নামের এক ব্যক্তি নারী ব্যবহার করে মাদকের ব্যবসা করেন। আমি তাঁদের কয়েকজনকে আটক করি। এ সময় ওই নারী আমার সঙ্গে দু-একবার কথা বলে অশালীন ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু যে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা এআই দিয়ে তৈরি করা। এটা ভুয়া।’ প্রত্যাহারের চিঠি পেয়েছেন বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন।

দেড় মাসে নানা অভিযোগ

চলতি বছরের ১৭ নভেম্বর পায়েল হোসেন ঢাকার রমনা থানা থেকে বদলি হয়ে চৌগাছা থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর পর থেকে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছেন। তবে ওসি পায়েল হোসেন সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

যোগদানের পর গত ২৩ নভেম্বর চৌগাছা উপজেলার সিংহঝুলি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হামিদ মল্লিককে পুলিশ দিয়ে থানায় ডেকে নিয়ে চাঁদা দাবি করেন বলে ওই ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে নির্যাতন করে ২০১৯ সালের মারামারির একটি মামলার সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। হামিদ মল্লিক উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে ইউপি নির্বাচন করায় তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।

হামিদ মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওসি সাহেব “চা খেতে ডাকছে” বলে পুলিশ আমাকে থানায় ডেকে নিয়ে যায়। এরপর ওসি বলেন, “৫ আগস্টের পর কোন সাহসে বাড়িতে আছেন? বাড়িতে থাকতে হলে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে।” আমি বলেছি, টাকা দেব না, মামলা দিলে দেন। এরপর তিনি এসআই মেহেদী হাসানকে ইশারা করলে আমাকে ওসির বাংলোবাড়িতে নিয়ে ছয় ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। পরে একটি পেন্ডিং মামলায় আমাকে আদালতে চালান দেওয়া হয়।’

অভিযোগের বিষয়ে ওসি পায়েল হোসেন বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান হামিদ মল্লিক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের জড়ো করছিলেন বলে অভিযোগ আছে। এ জন্য তাঁকে আটক করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘তাঁর (হামিদ) নাশকতার পরিকল্পনা ছিল।’

চৌগাছা বাস মালিক সমিতির সভাপতি ও উপজেলা যুবলীগের সদস্য জসিম উদ্দিনের স্বজনেরা অভিযোগ করেন, জসিম উদ্দিনের কাছে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন ওসি। চাঁদার টাকা না পেয়ে জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। তবে ওসি পায়েল হোসেন বলেন, সোনা চোরাচালান চক্রের সদস্য জসিম উদ্দিন। তাঁর বিরুদ্ধে অনেক মামলা আছে। তাঁকে আটক করার জন্য তাঁর বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছিল।

এ ছাড়া উপজেলার ভাদড়া গ্রামের বিএনপি নেতা ব্যবসায়ী মানিক হোসেন ও মাসিলা গ্রামের পারভেজ আহমেদ সোহাগকে আটক করে চাঁদা দাবির অভিযোগ ওঠে। চাঁদা না দেওয়ায় তাঁদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়। পরে ডাকাতি, ছিনতাই ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের বিভিন্ন সময়ের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় বলে স্বজনদের অভিযোগ।

এ বিষয়ে ওসি পায়েল হোসেন বলেন, ‘অভিযোগ সত্য নয়। অভিযুক্ত সোহাগ ভালো ছেলে না। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতির অভিযোগ আছে। চারটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে তাঁর কাছ থেকে।’

চৌগাছা বাজারের আরেক ব্যবসায়ী জীবন হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ‘ওসি আমার কাছে দুই লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিলেন। আমি এক লাখ টাকা দিয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে তিনি আরও এক লাখ টাকার জন্য আমাকে গালমন্দ করে হুমকি দেন।’

তবে ওসি পায়েল হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আটক সোহাগকে থানা থেকে মুক্ত করতে আমার নাম করে সোহাগের মা সাথিয়ার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন জীবন। এ জন্য “দালাল হইতে সাবধান” লিখে থানায় ব্যানার ঝোলানো হয়। আমি কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নিইনি।’

এ ব্যাপারে যশোরের পুলিশ সুপার জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ওসি পায়েলের বিরুদ্ধে বিতর্কিত নানা অভিযোগ এসেছে। এসব কর্মকাণ্ডে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। সব বিষয় তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁকে সাময়িক বরখাস্তের জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে সুপারিশ করা হবে।