আলু নিয়ে কত কিছু হয়, জানেন কী
এবার দেশের উত্তরাঞ্চলে আলুর ভালো ফলন হয়েছে। বাজারে চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি হওয়ায় আলুর দাম কম। ক্ষতি কমাতে কৃষক হিমাগারে আলু রেখে পরে বিক্রির চিন্তা করছেন। হিমাগারে তাই কৃষকের ভিড় বাড়ছে। মালিকেরা হিমাগার পরিচালনার খরচ বাড়ার কথা বলে ভাড়া বাড়িয়েছেন। রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় কৃষকেরা এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। সব মিলিয়ে হিমাগারমালিক ও আলুচাষিরা এখন মুখোমুখি অবস্থানে।
আলুচাষিদের কথা
আলু চাষের খরচের একটি ধারণা দেন নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার দুরাকুটি গ্রামের আলুচাষি মো. শামিম হোসেন। তিনি বলেন, এ বছর তিনি সাত বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। বীজ আলু লেগেছে ৪০ বস্তা। এর মূল্য ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে রাসায়নিক সারে ২১ হাজার, জৈব সারে ২১ হাজার, কীটনাশকে ১০ হাজার, কুয়াশানাশকে ১০ হাজার, আলু লাগানোর শ্রমিক খরচে ১৪ হাজার, নিরানী ও সেচে ২৫ হাজার, আলু তোলায় ৩৫ হাজার, পরিবহন ও অন্যান্য খরচ ৪০ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে ৭ বিঘা জমিতে তাঁর মোট খরচ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। আলু পেয়েছেন ২৪০ বস্তা বা ১ হাজার ৩০০ কেজি। বর্তমান বাজারমূল্যে প্রতি কেজি আলু ১৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলে দাঁড়ায় ১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। এ হিসাবে তাঁর লোকসান হবে ১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। লোকসান কমাতে তিনি যদি হিমাগারে আলু রাখতে যান, খরচ আরও বাড়বে।
আলুচাষিরা প্রতিবছর হিমাগারমালিকদের ছলচাতুরির মধ্যে পড়েন, এমন অভিযোগ ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আউলিয়াপুর এলাকার আলুচাষি শওকত হোসেনের। তিনি বলেন, এখন আলুর দাম কম। আলু হিমাগারে রেখে বছরের মাঝামাঝি সময়ে দাম বাড়লে বিক্রির আশা করেছিলেন কৃষকেরা। কিন্তু হুট করে হিমাগারমালিকেরা ভাড়া বাড়িয়ে দিলেন। বাড়তি ভাড়ায় আলু সংরক্ষণ করতে গেলে লাভ তো দূরের কথা, লোকসান বাড়বে।
হিমাগারভাড়াসহ অন্য খরচ যোগ করে আলু বিক্রি করতে হলে যে ক্রেতাদের বেশি দামে কিনতে হবে, স্পষ্ট করেই সেটা বললেন একই উপজেলার ঢোলারহাট গ্রামের আলুচাষি সন্তোষ বর্মণ।
ঠাকুরগাঁও জেলা আলুচাষি ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হকের অভিযোগ, হিমাগারের মালিকেরা ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে নিয়ম মানেননি। কৃষি বিপণন আইন-২০১৮ লংঘন করেছেন। হিমাগারভাড়া কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পরামর্শক্রমে সরকারি গেজেটের মাধ্যমে জানানোর কথা। কিন্তু হিমাগারের মালিকেরা সংবাদ সম্মেলন করে ভাড়া বাড়িয়ে দেন। তবে নীলফামারী হিমাগার মালিক সমিতির সদস্য মো. সৈয়দ আলী দাবি করেছেন, বাড়তি ভাড়ার ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
হিমাগারের ভাড়া বাড়ল কত
২০২৩ মৌসুমে হিমাগারে প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণে চাষিদের দিতে হতো ৩ টাকা ৫৭ পয়সা। ২০২৪ মৌসুমে তা বাড়িয়ে করা হয় ৫ টাকা ২০ পয়সা। আর এবার প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণে হিমাগারভাড়া হয়েছে ৮ টাকা। গত বছরের চেয়ে এবার ভাড়া বেড়েছে ২ টাকা ৮০ পয়সা।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর দুওসুও এলাকার আলুচাষি হামিদুর রহমান বলেন, জেলায় ১৭টি হিমাগার আছে। এসব হিমাগারে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫৩২ টন আলু সংরক্ষণ করা যায়। প্রতি কেজিতে খরচ ২ টাকা ৮০ পয়সা বাড়ায় হিমাগারভাড়ায় এবার আগের বছরের চেয়ে ৪০ কোটি ৭৪ লাখ ৮৯ হাজার ৬০০ টাকা বাড়তি দিতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩৪ হাজার ৭২৫ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। আর এ থেকে পাওয়া যাবে ৮ লাখ ৬৮ হাজার ১২৫ টন আলু।
প্রতিবছর হিমাগারে পাঁচ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করেন একই উপজেলার লালাপুর এলাকার আলু ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন। সে হিসাবে এই পরিমাণ আলু রাখতে গেলে তাঁকে বাড়তি সাত লাখ টাকা গুনতে হবে। এ অবস্থায় বাড়তি ভাড়া দিয়ে হিমাগারে আলু রাখবেন না অনেকেই। বিশেষ করে প্রান্তিক চাষিরা মাঠেই কম দামে আলু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
হিমাগারমালিকদের কথা
সাধারণত ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে হিমাগারে আলু সংরক্ষণ শুরু হয়, শেষ হয় জুলাই মাসে। এরপর খুচরা বাজারে সংরক্ষিত আলু বিক্রি শুরু হয়, চলে ডিসেম্বর পর্যন্ত। হিমাগারে আলু রাখার দুই রকমের বুকিং পদ্ধতি ‘লুজ বুকিং’ ও ‘পেইড বুকিং’। লুজ বুকিং হলো আলু বিক্রি করে হিমাগারমালিককে ভাড়া শোধ করতে হয়। এবার লুজ বুকিংয়ের রেট হচ্ছে ৫০ কেজি ওজনের ১ বস্তা আলু ৪০০ টাকা (প্রতি কেজি আলুর জন্য ৮ টাকা)। ঠাকুরগাঁও জেলার কোনো হিমাগার পেইড বুকিং নেয় না।
ভাড়া বাড়ানোর ব্যাখ্যা দেন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন ঠাকুরগাঁও জেলার সাধারণ সম্পাদক আরমান হোসেন। তিনি বলেন, হিমাগারের প্রধান ব্যয়ের খাত হচ্ছে ব্যাংক ঋণের কিস্তি ও বিদ্যুৎ বিল। গত এক বছরে সুদহার প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। বেড়েছে বিদ্যুৎ বিলও। এ ছাড়া হিমাগারে আলু আনা-নেওয়া, কর্মীদের বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক সব খরচই বেড়েছে। এসব আবশ্যক ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে এবার হিমাগারে আলু সংরক্ষণে কেজিপ্রতি ভাড়া ৯ টাকা ৬২ পয়সা হওয়ার কথা। তবে আলুচাষি ও ব্যবসায়ীদের কথা বিবেচনা করে তাঁরা ভাড়া আট টাকা করেছেন।
হিমাগারভাড়া সহনীয় পর্যায়ে আনতে পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছে এই অ্যাসোসিয়েশন। এসব দাবির মধ্যে আছে—ব্যাংকঋণের সুদহার ১৭ শতাংশ (দণ্ডসুদসহ) থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করা, বিদ্যুৎ বিলের ইউনিটপ্রতি খরচ কমিয়ে ৫ টাকা করা, হিমাগার–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যয়ের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করা; উৎসে কর প্রত্যাহার করা এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় ত্রৈমাসিকের পরিবর্তে বার্ষিক করা।
এসব দাবি পূরণ করা না হলে হিমাগারভাড়া কমানো সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করলেন নীলফামারী সদরের চাঁদেরহাটে অবস্থিত অংকুর বীজ অ্যান্ড হিমাগারের চেয়ারম্যান মো. হাসানুজ্জামান হাসান। তিনি বলেন, ব্যবসায় টিকে না থাকলে হিমাগারগুলো লোকসান দিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাবে।
আলু ফেলে প্রতিবাদ
হিমাগারমালিকদের সংগঠন ঢাকার পুরানা পল্টনে নিজদের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ভাড়া বাড়ান। পরে হিমাগারমালিকেরা নিজ নিজ হিমাগারে কেজিপ্রতি আট টাকা ভাড়ার কথা টানিয়ে দেন। রাজশাহীর আলুচাষিরা এর প্রতিবাদে ২ ফেব্রুয়ারি মোহনপুরে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কে আলু ফেলে বিক্ষোভ করেন।
১২ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আউলিয়াপুর এলাকার শাহী হিমাগারে বাড়তি ভাড়া নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের কথা-কাটাকাটি হয়। পরে হামলার ঘটনা ঘটে। পরের দিন দিনাজপুরের বীরগঞ্জে পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে সমাবেশ করেন আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা।
১৭ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলায় আলুচাষিরা মানববন্ধন করেন ও স্মারকলিপি দেন। ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে ঠাকুরগাঁও-রুহিয়া সড়কের ঢোলারহাট এলাকায় সড়কে আলু ফেলে বিক্ষোভও করেন কয়েক শ আলুচাষি।
হিমাগারের বর্তমান চিত্র
হিমাগারে আলু সংরক্ষণের জন্য আগে থেকে বুকিং দিতে হয় কৃষকদের। কে কী পরিমাণ আলু রাখতে চান, সেই অনুযায়ী হিমাগার কর্তৃপক্ষ বুকিং স্লিপ দেয়। কৃষকদের অভিযোগ, তাঁরা স্লিপ পাচ্ছেন না। হিমাগার কর্তৃপক্ষ প্রকৃত চাষিদের নয়, কেবল মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের স্লিপ দিচ্ছে। ফলে এলাকার চাষিরা হিমাগারে আলু রাখার সুযোগ পাচ্ছেন না। কম দামে তাঁরা আলু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, সামনেও হবেন।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বালিয়া গ্রামের কৃষক শুকানু রায় বলেন, ‘কুনো স্টোরত (হিমাগারে) যাওনি কহো? কুনঠেই স্লিপ পাওনি। স্লিপ পাওয়া না গেইলে আলুলা কম দামতেই বিকাবা (বিক্রি) হবে। লসের কথা ভাবিয়া মাথাখান অ্যালাই নষ্ট হয়া যাছে।’ বালিয়াডাঙ্গীর মহাজনপাড়া গ্রামের আলুচাষি আবদুর বাসেদ বলেন, ‘খেত থাকিয়া আলুই উঠিলনি, অ্যালাই স্টোরের স্লিপ নাই। এইখান কথা হইল? এর পেছনত স্টোরের মালিকলার কারসাজি আছে।’
অভিযোগের বিষয়ে সেলিম রেজা গ্রুপের (শাহী হিমাগার লিমিটেড) ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের চারটি হিমাগার আছে। সব হিমাগারেই আগাম বুকিংয়ের স্লিপ শেষ হয়ে গেছে। যেসব কৃষক বছরের পর বছর আলু সংরক্ষণ করেন, তাঁরা তাঁদের অগ্রাধিকার দেন। এবার আলু উৎপাদানের তুলনায় হিমাগারের ধারণক্ষমতা কম থাকায় সংকট হচ্ছে।
ভাড়া বাড়ানোর পরও হিমাগারে আলু রাখতে কৃষকের দীর্ঘ লাইন। নীলফামারী জেলা শহরের অদূরে উত্তরা বীজ হিমাগারে গিয়ে দেখা যায়, আলু রাখতে এসেছেন অনেক চাষি। জেলা সদরের পলাশবাড়ি থেকে আসা আলুচাষি হিরেন্দ্র নাথ রায় বলেন, ‘বীজ হিসেবে ১৫ বস্তা আলু রাখার জন্য এনেছি। সকাল থেকে অপেক্ষা করছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখাই হচ্ছে না। ভাড়া বেশি হোক, ঝামেলাটা কম হোক। এখন দেখি ভাড়াও বেশি, ঝামেলাও বেশি।’
এ বিষয়ে নীলফামারী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এস এম আবু বকর সাইফুল ইসলাম বলেন, এ বছর নীলফামারীতে ২১ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা ছিল। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ ৫ হাজার ৭৭০ টন। কৃষকেরা আবাদ করেছেন ২৩ হাজার ১৫৬ হেক্টর জমিতে। তাতে উৎপাদিত হবে প্রায় ছয় লাখ টন আলু। জেলার ১১টি হিমাগারে ধারণক্ষমতা ৮২ হাজার ২৫০ টন। আর সারা বছর জেলায় খাওয়ার আলুর প্রয়োজন ৮০ হাজার টন।
এস এম আবু বকর সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, গত বছর আলুর দাম বেশি থাকায় এ বছর আলুর আবাদ বেশি হয়েছে। কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে হলে উৎপাদনের আগে পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। বিদ্যুতের দাম বাড়ায় হিমাগারমালিকেরা ভাড়া বাড়িয়েছেন বলে মত তাঁর।
হিমাগারমালিক ও আলুচাষিদের মুখোমুখি অবস্থানের বিষয়টি জানা বলে জানালেন ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার নজরে আছে। দুই পক্ষের সঙ্গে বসার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশা করছি, কোনো পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’