যোগ্যতা নেই, তবু হলে থাকেন কুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) লালন শাহ হলের ৩০৮ নম্বর কক্ষে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নতুন সভাপতি রুদ্রনীল সিংহ। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল পরিচালনার নীতিমালা অনুযায়ী কয়েক বছর আগে তিনি হলে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। আবাসন–সংকট থাকলেও হল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
২০১৭ সালে একাডেমিক কাউন্সিলের ৫০তম সভায় গৃহীত কুয়েটের আবাসিক হল পরিচালনার নীতিমালা (সংশোধিত) অনুযায়ী আবাসিক শিক্ষার্থীদের নামে বরাদ্দ হওয়া আসন, তাঁদের সঙ্গে ভর্তি হওয়া নিয়মিত শিক্ষার্থীদের শেষ টার্মের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। তবে ডিগ্রি সম্পন্নের জন্য যেসব শিক্ষার্থীর কোর্স অসম্পূর্ণ থাকে, তাঁরা আবার হলে থাকার জন্য আবাসিক ছাত্র হিসেবে প্রভোস্ট বরাবর আবেদন করতে পারেন। এই অতিরিক্ত সময়কাল কোনোভাবেই দুই টার্মের (এক বছর) বেশি হবে না।
১০ অক্টোবর কুয়েটে ছয় সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ। কমিটিতে রুদ্রনীল সিংহকে সভাপতি করা হয়েছে। কমিটি ঘোষণার পর পদ পাওয়া নেতাদের নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ ‘যদি এক কোটি টাকা লাগে দেব, কমিটি আমার লাগবে’ সভাপতির এমন একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। এতে কুয়েট ছাত্রলীগ নিয়ে আবার নানা আলোচনা শুরু হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রুদ্রনীল সিংহ যন্ত্রকৌশল বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। একাডেমিক কাউন্সিলের অনুমোদনে অনিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি পড়াশোনা করছেন। তাঁর শিক্ষাবর্ষের নিয়মিত শিক্ষার্থীরা বছর পাঁচেক আগে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। ২০২১ সালে কুয়েটের লালন শাহ হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ মো. সেলিম হোসেনের মৃত্যুর ঘটনা কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটি যে ৪৪ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছিল, তাঁদের মধ্যে রুদ্রনীল সিংহও ছিলেন। তবে ওই শাস্তি স্থগিত করেন উচ্চ আদালত। এর আগে নিয়োগ-বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি ও হলে ভাঙচুরের অভিযোগে ২০১৬ সালে রুদ্রনীলকে এক টার্ম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। ওই বছরের এপ্রিলে টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন তিনি। এ ঘটনায় হল থেকেও তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
আজ বুধবার লালন শাহ হলে গিয়ে দেখা গেছে, হলের নতুন ভবনের তৃতীয় তলায় সিঁড়ির ডান পাশে ৩০৮ নম্বর কক্ষ। কক্ষটি তালাবদ্ধ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হলের একজন শিক্ষার্থী জানান, ৩০৮ নম্বর কক্ষেই ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি থাকেন। সভাপতি হওয়ার পর রাতে মাঝেমধ্যে সেখানে পার্টি হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত দুজন শিক্ষার্থী বলেন, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা হলে আসন পান না। তাঁদের অতিরিক্ত টাকা খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকতে হয়। অথচ যোগ্যতা না থাকার পরও নেতারা হলের আসন দখল করে থাকেন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলে উঠতে চাইলে নেতাদের খবরদারি থাকে। এ ব্যাপারে প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের সাবেক একজন প্রভোস্ট প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগ নেতারা নিয়মের বাইরে থেকে অনেক কিছু করতে চান। নেতাদের পড়াশোনা শেষ ও আসন বাতিল হওয়ার পরও তাঁরা তা দখলে রাখেন।
অভিযোগের বিষয়ে রুদ্রনীল সিংহকে কল করা হলে তিনি এক ঘণ্টা পরে আবার কল দিতে বলেন। পরে আবার কল করলে একটি অনুষ্ঠানে আছেন বলে ফোন রেখে দেন।
লালন শাহ হলের প্রভোস্ট মো. আবদুল হাফিজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিনতলার একটি কক্ষে রুদ্রনীল সিংহ থাকেন। পুরোনো হল ভেঙে নতুন হল করা হয়েছে। কয়েক মাস আগে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি আসার আগে যেসব শিক্ষার্থীর নামে কক্ষ বরাদ্দ ছিল, পুরোনো ভবন থেকে তাঁদের শুধু নতুন ভবনে স্থানান্তর করেছেন। নীতিমালার বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘এইটা আসলে আমি বলতে পারব না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে আমাদের পুরোনো ছেলেরা অনেকে থাকেন।’
এদিকে ছাত্রলীগের নতুন কমিটির ছয়জনের মধ্যে সভাপতি ছাড়াও সাধারণ সম্পাদক এ কে এম নিবিড় রেজা (২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ) ও সাংগঠনিক সম্পাদক রাগীব আহসান (২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ) অনিয়মিত শিক্ষার্থী। নিবিড় রেজা ক্যাম্পাস-সংলগ্ন একটি মেসে থাকেন; মাঝেমধ্যে খানজাহান আলী হলে রাত কাটান। রাগীব আহসান ড. এম এ রশিদ হলে সংযুক্ত থাকলেও হল থেকে আজীবনের বহিষ্কারাদেশ থাকায় তিনি ফজলুল হক হলের ৩১১ নম্বর কক্ষে থাকেন। এখন ক্যাম্পাসে খুব একটা না থাকলেও ক্যাম্পাসে এলে তিনি হলে থাকেন।
সাধারণ সম্পাদক এ কে এম নিবিড় রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ব্যাচ থেকে আমাদের ওপরের ব্যাচের কেউ হলে থাকতে পারবেন না—এমন নোটিশ পাওয়ার পর আমি সিট ছেড়ে দিয়েছিলাম। হলে আমার নামে কোনো সিট বরাদ্দ নেই।’