আমজাদুল নিজে রক্ত দেন, অন্যদের উদ্বুদ্ধ করেন
থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত তিন বছর বয়সী অসুস্থ এক মেয়েশিশুকে দেখতে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় ভাই মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা শিশু হাসপাতালে গিয়েছিলেন আমজাদুল ইসলাম। শিশুটির জন্য এ পজিটিভ রক্ত জোগাড় করতে না পেরে পরিবারের সদস্যদের চোখেমুখে তখন হতাশার ছাপ। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে থাকা ফুটফুটে শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে অন্য রকম ব্যথা অনুভব করেন আমজাদুল।
শিশুটির রক্তের সঙ্গে নিজের রক্তের গ্রুপ মিলে যাওয়ায় আমজাদুল স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে আসেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল টেকনোলজির (বিআইএমডিটি) প্রথম বর্ষে পড়া অবস্থায় এমন ঘটনার মুখোমুখি হন তিনি। সেই থেকে তাঁর স্বেচ্ছায় রক্তদান শুরু, যা এখনো অব্যাহত আছে। পাশাপাশি অন্যদেরও স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন।
৪৩ বছর বয়সী আমজাদুল ইসলাম বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা জেলা হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) হিসেবে কর্মরত। তাঁর বাড়ি চুয়াডাঙ্গা শহরের সিঅ্যান্ডবি পাড়ায়। একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করে ২০০৩ সালে নড়াইলের কালিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) হিসেবে চাকরি যোগ দেন তিনি। এরপর ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল), চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা ও দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকরি করেছেন। তবে যখন যেখানে গেছেন, দিনে-রাতে মুমূর্ষু রোগীর রক্তের প্রয়োজন মেটাতে পাশে থেকেছেন। তিনি কারও কারও কাছে ‘চলমান ব্লাড ব্যাংক’ হিসেবেও পরিচিত। ২০০৬ সাল থেকে তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলা হাসপাতালে কর্মরত। তিনি যেমন মুমূর্ষু রোগীর জন্য রক্তের ব্যবস্থা করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন, বিভিন্ন রোগীর স্বজনেরাও রক্তের প্রয়োজনে তাঁর কাছে ছুটে আসেন।
নিরাপদ রক্তের প্রয়োজন মেটাতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করেন আমজাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষ প্রতি চার মাস পরপর স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে পারেন। এতে কোনো ক্ষতি নেই। এ পর্যন্ত তিনি স্বেচ্ছায় ৩৭ বার রক্ত দিয়েছেন। তরুণ স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের কাছ থেকে ২০ হাজারে বেশি রক্তের ব্যাগ জোগাড় করে বিভিন্ন রোগীদের সরবরাহ করেছেন।
আজ ১৪ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। যাঁরা স্বেচ্ছায় ও বিনা মূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন, সেই রক্তদাতাসহ সাধারণ মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এ দিবসের মূল্য উদ্দেশ্য। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিবসটি পালন করে আসছে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে কিছুদিন ধরে স্বেচ্ছায় রক্তদান বন্ধ রেখেছেন আমজাদুল ইসলাম। তবে মুমূর্ষু রোগীদের জন্য প্রতিদিনই স্বেচ্ছায় রক্তদাতা জোগাড় করে দেন। আমজাদুল বলেন, জটিল রোগী হিসেবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বার রক্ত দিয়েছেন তাপস কুমার নামের এক শিশুকে। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দরিদ্র পরিবারের এই শিশুকে তার ৬ থেকে ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি রক্ত দিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তাপসকে বাঁচানো যায়নি। জীবনের প্রথম রক্ত দেওয়া ঢাকার শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশুটিকেও বাঁচানো যায়নি। তবে রক্ত পেয়ে রোগী ও রোগীর স্বজনদের যে স্বস্তির অবস্থা হয়, সেটা আনন্দের অনুভূতি দেয়।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের গাইনি বিভাগের কনসালট্যান্ট আকলিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, অনেক মা রক্তশূন্যতা নিয়ে স্বাভাবিক প্রসবের জন্য হাসপাতালে আসেন। এমন রোগীদের রক্তের প্রয়োজন হয়। আমজাদুলের উৎসাহে তরুণেরা এখন স্বেচ্ছায় রক্তদানে এগিয়ে আসায় নিরাপদ রক্তের প্রবাহ চালু হয়েছে।
শহরের মল্লিকপাড়ার বাসিন্দা গৃহবধূ রহিমা খাতুন বলেন, অন্তঃসত্ত্বা নিকট আত্মীয়কে নিয়ে হাসপাতালে আসার পর তিনি জানতে পারেন জরুরিভাবে রক্ত দিতে হবে। খবর পেয়ে রাত আড়াইটার সময় আমজাদুল এসে রক্ত দিয়ে তাঁর জীবন বাঁচান।
স্বেচ্ছায় ও বিনা মূল্যে রক্তদানের উদ্দেশ্যে চুয়াডাঙ্গায় গত পাঁচ বছরে বেশ কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন ‘বাঁধন’-এর চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ ইউনিটের সভাপতি আজিজুর রহমান বলেন, ২০১৭ সাল থেকে পাঁচ বছরে তাঁদের নিবন্ধিত পাঁচ শতাধিক সদস্য ও রক্তদাতারা অন্তত ৭ হাজার ৫০০ ব্যাগ রক্তদান করেছেন।
আল-মুহসীন সমাজসেবা রক্তদান সংস্থার সমন্বয়কারী ইউসুফ হোসেন বলেন, মাত্র এক বছরেই তাঁরা ৭০০ রক্তদাতার (ডোনার) নাম তালিকাভুক্ত করেছেন এবং ৩০০ জনকে রক্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।