ভ্যানে লাশের স্তূপ করছে পুলিশ, ভাইরাল ভিডিও নিয়ে যা জানা গেল
মাথায় পুলিশের হেলমেট। সাদাপোশাকের ওপর পুলিশের ভেস্ট পরা এক ব্যক্তি আরেকজনের সহায়তায় চ্যাংদোলা করে নিথর এক যুবকের দুই হাত ধরে ভ্যানের ওপর তুলছেন। ভ্যানের ওপর আরও কয়েকটি নিথর দেহ স্তূপ করে রাখা। দেহগুলো থেকে ঝরে পড়া রক্তে ভিজে গেছে সড়কের কিছু অংশ। বিছানার চাদরের মতো একটি চাদর দিয়ে তাঁদের ঢেকে রাখা হয়েছে। পাশেই পুলিশের হেলমেট, ভেস্ট পরা আরও কয়েকজনকে দেখা যায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের ভিডিওটি সাভারের আশুলিয়া থানা-সংলগ্ন এলাকার বলে দাবি করেছেন অনেকে। এএফপির ফ্যাক্ট-চেকিং এডিটর কদরুদ্দীন শিশির তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে ঘটনাটি ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার নিকটবর্তী এলাকায় বলে উল্লেখ করেছেন।
সরেজমিনে ভিডিওটির আশপাশের নানা বিষয় পর্যালোচনা করে এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে স্থানটি আশুলিয়া থানা লাগোয়া ‘ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লি. অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টারের’ পাশের সড়ক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ঘটনাস্থল হিসেবে দাবি করা জায়গাটি থেকে ১০ থেকে ১৫ ফুটের দূরত্বে ‘সাদিয়া রাজশাহী কনফেকশনারি অ্যান্ড মিষ্টান্ন ভান্ডার’ নামে একটি দোকান আছে। দোকানের মালিক ফাহিমাকে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি দেখানো হলে তিনি স্থানটি নিশ্চিত করেন। ফাহিমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘হ্যা, এটাই ওই জায়গা। বালুর বস্তা পালা দিয়ে ব্যারিকেড বানিয়ে ছিল।’
ভিডিওটিতে আরও দেখা যায়, ঘটনাস্থলের পাশের ‘ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লি. অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টার’-এর দেয়ালে নির্বাচনী পোস্টার টাঙানো আছে। দেয়ালের ভেতরের অংশের একটি গাছের পাতা এসে পড়েছে সড়কের দিকে। দেয়ালের একটি অংশে কিছুটা বাঁক আছে। দেয়ালের নিচের দিকে কিছু অংশ কালো।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, ভিডিওটি ঘটনাস্থলের পাশেই একটি তিনতলা ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে বাড়ির একাধিক ভাড়াটে ও মালিকের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা ভিডিওর ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দেয়ালে আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পদপ্রার্থী আবুল হোসেনের ছবি-সংবলিত পোস্টারটিতে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। দেয়ালের ভেতরের অংশের গাছটি আমগাছ। সেটির পাতা সড়কের দিকে এসেছে। দেয়ালের একটি অংশে বাঁক দেখা যায়। দেয়ালের নিচের দিকে কিছু অংশে কালো রং করা হয়েছে।
ভিডিওতে হেলমেট হাত ও পুলিশের ভেস্ট পরা ব্যক্তি ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলে দাবি করছেন অনেকে। এ বিষয়ে কথা বলতে ওই কর্মকর্তার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নির্বিচার গুলি চালালে বেশ কয়েকজন নিহত হন। আহত হন অনেকে। রাতে আশুলিয়া থানার অদূরে নবীনগর থেকে চন্দ্রাগামী মহাসড়কের এক পাশে পুলিশ লেখা পিকআপের আগুনে ভস্মীভূত অন্তত দুটি মরদেহ দেখেন তাঁরা। এ ছাড়া থানার সামনে আগুনে পোড়া একটি মরদেহ ছিল। পদচারী–সেতুতে উল্টো করে ঝোলানো ছিল ক্ষতবিক্ষত দুই পুলিশ সদস্যের লাশ। তখন স্থানীয় লোকজন আগুনে ভস্মীভূত একাধিক লাশ পিকআপে থাকতে পারে বলে ধারণা করেছিলেন। ওই রাতে আশুলিয়া থানায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
পরদিন পুলিশ লেখা পিকআপে আগুনে পুড়ে যাওয়া একজনকে শনাক্ত করেছিলেন বলে স্বজনেরা জানান। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেনের মা শাহিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫ আগস্ট থেকে ছেলে নিখোঁজ ছিল। পরদিন পুলিশের পিকআপ থেকে আগুনে পোড়া লাশ পাই। লাশের পকেটে আইডি কার্ড দেখে ছেলের লাশ চিনতে পারি। ৭ তারিখে গাইবান্ধার শ্যামপুর গ্রামে লাশ দাফন করেছি।’
আশুলিয়া এলাকার বিভিন্ন হাসপাতালের তথ্যমতে, আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় হামলার ঘটনায় ১৪ জন নিহত হন। এ ছাড়া আশুলিয়া থানা এলাকায় তিনজন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত পাঁচজন নিহত হন।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আহম্মদ মুঈদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিডিওটি আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি। আমাদের বিশেষজ্ঞ টিম সেটি নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া ভিডিওতে দেখতে পাওয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিদের অনেকে চিনেছেন বলে আমাদের তথ্য দিচ্ছেন। আমরাও বিষয়টি নিশ্চিত হতে কাজ করছি।’