৩০ বছরের বিরোধ মেটানো হলো যেভাবে
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইবাড়ি ইউনিয়নের আমতলা গ্রামের এক ব্যক্তি ৩০ বছর আগে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সদস্য প্রার্থী হয়েছিলেন। নির্বাচনে ওই ব্যক্তি পরাজিত হওয়ার পর গ্রামে দুটি পক্ষ তৈরি হয়। এক পক্ষের নেতৃত্ব দেন মো. রফিকুল ইসলাম, অপর পক্ষের আবদুর রাজ্জাক ওরফে নারু মিয়া।
পক্ষ দুটির মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, জমি দখল ও তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে তিন দশক ধরে দফায় দফায় সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর ও মামলা-মোকদ্দমা চলছিল। এসব বিষয় নিয়ে গ্রামটি অশান্ত ছিল। অবশেষে কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমদাদুল হক তালুকদারের উদ্যোগে গতকাল বুধবার রাতে দীর্ঘ তিন দশকের বিরোধ মীমাংসা করে দেওয়া হয়েছে। এতে গ্রামের লোকজনের মধ্যে ফিরেছে স্বস্তি।
এ বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার সকালে মুঠোফোনে ইউএনও ইমদাদুল হক তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, আমতলা গ্রামের দুই পক্ষের বিরোধের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় বিঘ্ন ঘটছিল। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় অসুবিধা হচ্ছিল। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা, এলাকার গণ্যমান্য লোকজন নিয়ে প্রশাসন সংহতি সভার মাধ্যমে দুই পক্ষের বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এটি সুখের বিষয়। আশা করছেন গ্রামের বিরোধ ও সংঘাত এখন সম্প্রীতিতে রূপ নেবে।
উপজেলা প্রশাসন, থানা-পুলিশ ও গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই পক্ষের বিরোধকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় হামলা, মারামারি, গাছ কেটে নেওয়া, বাড়িঘর ভাঙচুর, পুকুরে বিষ প্রয়োগ করে মাছ নিধন, গরু চুরিসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। কিছুদিন পরপরই দুই পক্ষের উত্তেজনা ছড়ায়। এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এর আগেও উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।
সর্বশেষ গত রোববার রাতে বিবদমান দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ানোর ঘোষণা দেয়। পরদিন সোমবার সকাল ১০টায় সংঘর্ষের স্থান ও সময় নির্ধারণ করা হয়। এ জন্য পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে উভয় পক্ষের লোকজন বিপুল পরিমাণ ধারালো দেশীয় অস্ত্র, রামদা, কিরিচ, ঢাল, বল্লম, টেঁটা, ইট-পাথর, হেলমেট যার যার বাড়িঘরে মজুত করে রাখে। বিষয়টি জানতে পেরে ওই দিন রাত একটার দিকে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাজিব হোসেন, কেন্দুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এনামুল হককে সঙ্গে নিয়ে আমতলা গ্রামে হাজির হন ইউএনও ইমদাদুল হক তালুকদার। সেখানে অভিযান চালিয়ে পুলিশ অস্ত্রসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করে। পরে ইউএনও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় উভয় পক্ষকে নিয়ে সংহতি সভার আহ্বান জানান।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আলোচনায় বসেন ইউএনও। এতে পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদুল হক ভূঁইয়া, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাজিব হোসেন, কেন্দুয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার হোসাইন মোহম্মদ ফারাবি, ওসি মো. এনামুল হক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কাদির ভূঁইয়া, রোয়াইলবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মো. লুৎফুর রহমান আকন্দসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ দুই পক্ষের শতাধিক লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
ইউএনওর সভাপতিত্বে সংহতি সভায় প্রথমে উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনা হয়। পরে সবার সম্মতিতে ১০ সদস্যের একটি জুরিবোর্ড গঠন করা হয়। জুরিবোর্ড আলোচনা শেষে তিনটি সিদ্ধান্ত দেয়। এক. উভয় পক্ষের চলমান মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সার্কেল এএসপির নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়। যার মাধ্যমে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হলো দুই পক্ষের চলমান জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধ বিষয়ে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) নেতৃত্বে নিষ্পত্তি করা। তৃতীয় সিদ্ধান্ত হলো ভবিষ্যতে কোনো প্রকার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে প্রচলিত আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে তা দমন করা।
সভায় এসব সিদ্ধান্ত উভয় পক্ষের লোকজন করতালি দিয়ে মেনে নেন। দুই পক্ষের লোকজন আর বিরোধে জড়াবেন না বলেও প্রতিশ্রুতি দেন। পরে তাঁরা একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। দীর্ঘ বছরের বিবাদ ও সংঘাত নিষ্পত্তি হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে বলে মনে করছেন স্থানীয় লোকজন।
সভায় অংশ নেওয়া স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী ও ছড়াকার রহমান জীবন বলেন, ইউএনওর উদ্যোগে আমতলা গ্রামের দীর্ঘ ৩০ বছরের বিরোধের অবসান ঘটেছে। দুই পক্ষের নেতৃত্বদানকারী রফিকুল ইসলাম ও আবদুর রাজ্জাক পরস্পর বুকে বুক মিলিয়ে হিংসা-বিদ্বেষের অবসান ঘটান। এ সময় আনন্দ ও অনুতাপে তাঁদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। এতে উপস্থিত গ্রামবাসীর মুখে হাসি ফোটে।
এ বিষয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হিংসা, ঝগড়া-বিদ্বেষ কখনো শান্তি দিতে পারে না। ইউএনও মহোদয়ের উদ্যোগে আমরা উভয় পক্ষ সমঝোতার মাধ্যমে মিলে গেছি। এখন থেকে আমরা সবাই একসঙ্গে চলব।’
আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘এই ৩০ বছর একটা অশান্ত সময় পার করতে হয়েছে। হামলা ও মামলা-মোকদ্দমায় উভয় পক্ষের অনেক টাকাপয়সা ও সম্পদ নষ্ট হয়েছে।নিজেদের গ্রামে বিরোধ থাকায় অন্য গ্রামের মানুষেরাও তাঁদের ভালো চেখে দেখত না।’
ওসি মো. এনামুল হক বলেন, আলোচনার মাধ্যমে উভয় পক্ষ ভবিষ্যতে আর সংঘাতে না জড়ানোর বিষয়ে কথা দিয়েছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ।