২০ বছর মামলা লড়ে চাকরি ফিরে পেলেন পঞ্চগড়ের আকবর
১৯৯২ সালে টগবগে যুবক ছিলেন আকবর হোসেন। স্থানীয় আরও তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে এলাকার বিত্তশালীদের কাছ থেকে ৩৯ শতাংশ জমি সংগ্রহ করে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কাজ শুরু করেন তিনি। নিজে প্রধান শিক্ষক আর অপর তিনজনকে সহকারী শিক্ষক করে সেখানেই শুরু করেন স্থানীয় শিশুদের পাঠদান। কিন্তু বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ২০ বছর ধরে তাঁকে চাকরির বাইরে থাকতে হয়েছে। মামলা লড়ে জয়ী হয়ে তিনি চাকরি ফিরে পেয়েছেন।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার নয়নীবুরুজ দীঘলগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। আদালতের নির্দেশে ২ নভেম্বর আকবর হোসেন প্রধান শিক্ষক পদে ওই বিদ্যালয়ে ফেরেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষক, পরিচালনা পর্ষদ ও স্থানীয় লোকজন তাঁকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
সোমবার দুপুরে নয়নীবুরুজ দীঘলগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষকদের কক্ষে প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসে আছেন আকবর হোসেন। পাশে বসে আছেন বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি শাহাজাহান আলী ও অন্য শিক্ষকেরা। টিফিনের বিরতির পর আকবর হোসেন শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে যান। আকবরসহ ওই বিদ্যালয়ে এখন শিক্ষক ছয়জন। আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৫ জন।
আকবর হোসেনের বয়স এখন ৫১ বছর। চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে গত ২০ বছরে তিনি মুরগির খামারে কাজ করে, ঢাকায় রিকশা চালিয়ে জীবন চালান। তিনি পঞ্চগড় সদর উপজেলার কাপরাঙ্গাপাড়া এলাকার বাসিন্দা।
আকবরের ভাষ্য, আকবর হোসেনের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি ১৯৯৬ সালে এমপিওভুক্ত করা হয়। সরকারিভাবে বিদ্যালয়ের ভবন করা হয়। ২০০১ সালে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হবিবর রহমানের সঙ্গে নানা বিষয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় তাঁর। ওই বছর স্ত্রীর সঙ্গে পারিবারিক কলহের একটি মামলায় তিন মাস হাজতে ছিলেন তিনি। পরে পারিবারিকভাবে সমঝোতা হওয়ায় জামিনে তিনি মুক্তি পান। কারাগার থেকে বের হয়ে বিদ্যালয়ে যেতে চাইলে তাঁকে বিদ্যালয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তখন। কারাগারে থাকার সময়টাকে অনুপস্থিত দেখিয়ে তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। হবিবর রহমানের স্বজন আয়েশা সিদ্দিকাকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
আকবরের দাবি, এ ঘটনায় ২০০৩ সালের শেষের দিকে পঞ্চগড়ের আদালতে মামলা করেন আকবর হোসেন। আদালত তাঁর পদে নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দিলেও পরের বছরের ৫ জুলাই আয়েশা সিদ্দিকা প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর ওই মামলায় আকবর হোসেনকে স্বপদে বহাল এবং তাঁর বকেয়া বেতন পরিশোধের নির্দেশ দেন আদালত। দুই পক্ষের আপিল আর পাল্টা আপিলে মামলা গড়ায় উচ্চ আদালত পর্যন্ত। এর মধ্যে ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি সরকারীকরণ হয়। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৮ মে আপিল বিভাগ শুনানি শেষে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন। আয়েশা সিদ্দিকার নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আকবরকে যোগদান করতে দিতে টালবাহানা শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ।
আকবর হোসেন ২০২২ সালের শেষের দিকে আবারও পঞ্চগড়ের সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে একটি জারি মামলা করেন। আদালতের নির্দেশ অমান্য করায় বিচারক গত ২৯ অক্টোবর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তাড়াহুড়ো করে ২ নভেম্বর পঞ্চগড় সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে আকবর হোসেনকে যোগদান করিয়ে বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদে সংযুক্ত করা হয়।
আকবর হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘ ২০ বছর মামলার পেছনে আমার যেটুকু সম্বল ছিল, সব শেষ করে ফেলেছি। এই ২০ বছর জীবনে কঠিন সময় গেছে। না খেয়ে আদালতের বারান্দায় ঘুরেছি। অভাবের তাড়নায় ঢাকায় গিয়ে পোলট্রি ফার্মে কাজ করেছি। কয়েক দিন রিকশাও চালিয়েছি। আদালত আমার সব বকেয়া পাওনা দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। সেই টাকা অল্প সময়ের মধ্যে পাওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
আকবর হোসেনের আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আদালত বিবাদীদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও তাঁরা কোনো জবাব দেননি। পরে আদালত তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ারা জারি করেন। প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা কাগজপত্র যাচাই করে গত বৃহস্পতিবার আকবরকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করান।
পঞ্চগড় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, আকবর হোসেনের কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। এখন বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে তাঁকে গেজেটভুক্ত করতে কিছুটা সময় লাগবে।