হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ
দুটি সড়কে গতি পেল ভাটির অর্থনীতির চাকা
ভাটি এলাকা হিসেবে পরিচিত আজমিরীগঞ্জ। কয়েক বছর আগেও উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ ছিল না। মানুষ বছরে ছয় মাস পানিবন্দী থাকত। এখন পাল্টে গেছে এ চিত্র।
হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার আবু মুসা (২৯) তিন বছর আগেও বেকার ছিলেন। এখন তিনি মাছ চাষ করে বছরে আয় করছেন ৫০ লাখ টাকা। একই উপজেলার রতিশ দেবনাথ (৪০) হাঁসের খামার করে আয় করছেন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের যোগাযোগের উন্নয়নই তাঁদের ভাগ্যের এমন পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
ভাটি এলাকা হিসেবে পরিচিত আজমিরীগঞ্জ। এ উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। কয়েক বছর আগেও উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ ছিল না। মানুষ বছরে ছয় মাস পানিবন্দী থাকত। এখন পাল্টে গেছে এ চিত্র। এখন আজমিরীগঞ্জের মাছ ও খামারের হাঁস প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে যাচ্ছে। এ খাতে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। এ ব্যবসা করে বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন অনেক তরুণ।
জেলা সদর থেকে উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। এ সড়কের বানিয়াচং ভায়া শিবপাশা আজমিরীগঞ্জ ১৬ কিলোমিটার সড়কটি ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নির্মাণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) এবং হবিগঞ্জ ভায়া বানিয়াচং শরীফ উদ্দিন সড়কটি নির্মাণে করে হবিগঞ্জ সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। এ দুটি সড়কেই পাল্টে যায় উপজেলার অথনৈতিক চিত্রও। এ উপজেলার মানুষ এখন শুধু কৃষিনির্ভর নয়, এখানে কৃষির পাশাপাশি মৎস্য ও হাঁসের খামার ব্যবসারও প্রসার ঘটেছে।
আমিরগঞ্জ মৎস্য আড়তে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার বিভিন্ন হাওর, নদী, জলাশয়, পুকুর ও মৎস্য খামার থেকে মাছ নিয়ে জড়ো হয়েছেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা। ছোট ছোট ট্রাকে করে এ মাছ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এ সময় কথা হয় মৎস্য ব্যবসায়ী রহমত আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আজমিরীগঞ্জসহ উপজেলার কাকাইলছেও, পাহাড়পুরসহ পাঁচটি স্থানে প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত আড়ত বসে। এসব আড়তে প্রতিদিন কোটি টাকার ওপরে বেচাকেনা হয়।
শরীফনগর ও শিবপাশা সংযোগ মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, কিছু পিকআপ ভ্যান দাঁড়ানো। এসব পিকআপ ভ্যানে বিভিন্ন খামার থেকে সংগ্রহ করা হাঁস ওঠানো হচ্ছে। এ সময় শরীফনগর গ্রামের ফারুক মিয়া বলেন, ‘আমাদের এলাকার হাঁস পিকআপ ভ্যানে করে প্রতিদিন ঢাকায় যাচ্ছে। অথচ একসময় আমরা পানিবন্দী থাকতাম বছরের ছয় মাস। নতুন সড়ক হওয়ার পর এখানকার খামারিরা ঢাকার সঙ্গে ব্যবসা করতে পারছেন। বৃদ্ধি পেয়েছে হাঁসের খামার ব্যবসাও।’
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আজমিরীগঞ্জে দুই-তিন বছর আগেও হাঁসের তেমন খামার ছিল না। সে সময় গ্রামবাসী নিজেদের প্রয়োজন ও স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্য হাঁস লালন-পালন করতেন। বর্তমানে ঘরে ঘরে হাঁস পালনের প্রবণতা বেড়েছে। খামার গড়ে উঠেছে ২৫৭টি। এসব খামার থেকে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার হাঁস উপজেলার বাইরে যাচ্ছে। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার হাঁস বেচাকেনা হয়।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেন, এ অঞ্চলের মানুষ নদী ও জলাশয়ের মাছের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আগে এখানে মাত্র দুই থেকে তিনটি মাছের খামার ছিল। যোগাযোগের উন্নয়নে কয়েক বছরে শতাধিক মৎস্য প্রকল্প গড়ে উঠেছে। বেকার অনেকেই মাছ ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছেন। বিশেষ করে উপজেলার জলসুখা গ্রামের আবু মুসা নামের এক তরুণ ও বদলপুর গ্রামের সুসেনজিৎ চৌধুরী নাম উল্লেখ করার মতো। এখন এখানে পাঁচটি আড়তে প্রতিদিন কোটি টাকার মাছ বেচাকেনা হয়। এ মাছ ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে যায়।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মানসুরুল হক বলেন, প্রতিদিন উপজেলায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার হাঁস বেচাকেনা হয়। একজন সফল খামারি প্রতি হাজার হাঁস থেকে বছরে তিন থেকে চার লাখ টাকা আয় করেন। তবে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে এ ব্যবসা দ্বিগুণ হয়ে যায়। বর্তমানে ঢাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেও হাঁসের ব্যবসা করছেন।
আজমিরীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুলতানা সালেহা সুমি প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো এলাকার উন্নয়নের প্রথম শর্ত হচ্ছে যোগাযোগের উন্নয়ন। আগে আজমিরীগঞ্জ ছয় মাস পানিবন্দী থাকত। আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে সেই দৃশ্য পাল্টে গেছে, মানুষ উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে। বিশেষ করে এ অঞ্চলে হাঁস ও মাছের খামার বৃদ্ধি পেয়েছে। বেকারত্ব দূর হচ্ছে।