স্বজনহারাদের নিরানন্দ ঈদ

৯ বছরের ছেলে সোলায়মানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা রানী আক্তার। গতকাল কালিয়াকৈরের তেলিরচালায়ছবি: প্রথম আলো

তিন মাস আগে পোশাকশ্রমিক দম্পতি সুমি-আরিফুলের ঘর আলো করে জন্ম নেয় ছোট্ট শিশু সুমাইয়া। প্রথম সন্তান জন্মের প্রায় ১১ বছর পর সুমাইয়াকে পেয়ে তাঁদের আনন্দের শেষ নেই।

ইচ্ছা ছিল এবার ঈদে পরিবারের সবার জন্য নতুন কাপড় কিনে গ্রামের বাড়ি যাবেন। সুমাইয়ার জন্ম উপলক্ষে গ্রামের কিছু মানুষ (মোল্যা) দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবেন। সে অনুযায়ী টাকাও জমাচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু এর মধ্যেই হঠাৎ শূন্যে হারিয়ে গেলেন আরিফুল। ঈদ ঘিরে তাঁদের স্বপ্ন মুহূর্তেই রূপ নিল বিষাদে।

আরিফুল গত ১৩ মার্চ গাজীপুরের কালিয়াকৈরের তেলিরচালায় শ্রমিক কলোনিতে সিলিন্ডার গ্যাস থেকে লাগা আগুনে মৃত ১৭ ব্যক্তির একজন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৭ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত্যুর ১৮ দিন পরও শোকে কাতর পরিবার। বিশেষ করে ঈদ ঘিরে এই পরিবারে নেই কোনো আনন্দ।

গত বুধবার দুপুরে কলোনির ১ নম্বর গলির ২ নম্বর ঘরে পাওয়া যায় সুমিকে। তখন শ্বশুরবাড়ি রাজশাহী যাওয়ার উদ্দেশে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। তাঁকে বিদায় দিতে এসেছেন কয়েকজন পাড়া-প্রতিবেশী। কিন্তু সুমির মন টানছে না কিছুতেই। স্বামীকে ছাড়া একা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা ভাবতেই চোখে জল আসছিল তাঁর।

সুমি বলছিলেন, ‘বাবু হওয়ার পর এবারই প্রথম গ্রামে যাচ্ছি। ইচ্ছা ছিল ঈদে বাড়ির সবার লাইগ্যা নতুন কাপড় কিনন্যা এক লগে বাড়ি যামু। কিন্তু এহন সে (আরিফুল) নাই। তারে ছাড়া একা বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবতেই বুকটা ফাইটা যাইতাছে।’

সুমির সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একটি ছবি হাতে এগিয়ে এলেন একই গলির ষাটোর্ধ্ব শফিকুল ইসলাম। হাতের ছবিটি তাঁর ছেলে সোলাইমানের (৮)। একই আগুনে দগ্ধ হয়ে গত ১৮ মার্চ মারা যায় সে। তার মৃত্যুর পর থেকেই পাগলপ্রায় শফিকুল। যেখানেই যাচ্ছেন, সঙ্গে বয়ে বেড়াচ্ছেন ছেলের ছবি।

সুমি ও শফিকুলরা যে গলিতে থাকেন, তার এক গলি পরেই একই ঘটনায় মৃত মো. কুটি ফকিরের বাসা। কুটির স্ত্রী দুলু খাতুন পোশাক কারখানার শ্রমিক। তাঁদের তিন মেয়ে। কুটির মৃত্যুর পর দুলু খাতুন মেয়েদের কথা ভেবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এক সপ্তাহ ধরে কারখানায় কাজে যেতে পারছেন না। তিন মেয়ের মধ্যে দুজনই ছোট। ঈদ ঘিরে বায়না ধরেছে বিভিন্ন জিনিসের। কিন্তু দুলু স্বামীর শোক ভুলবেন, নাকি সন্তানদের ঈদের চাহিদা মেটাবেন, তা ভাবতেই দিশাহারা।

স্ত্রীর মৃত্যুর পর মেয়ে শাহানাজ ও ছেলে গোলাম রব্বানীকে নিয়ে একই কলোনিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের মো. শাহালম। তিনি পেশায় আইসক্রিম বিক্রেতা। মেয়ে শাহনাজকে বিয়ে দিয়েছেন এরই মধ্যে। ছেলে গোলাম রব্বানী পড়াশোনা করে নাটোর দয়ারামপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি স্কুলে। ঈদের ছুটি উপলক্ষে ১০ মার্চ তাঁর কাছে এসেছিল গোলাম রব্বানী। ঈদের কেনাকাটার জন্য পড়াশোনার খরচ বাঁচিয়ে ৭ হাজার টাকা জমিয়েছিল সে। কথা ছিল, শাহালম আরও কিছু টাকা যোগ করে তার (গোলাম রব্বানী) পছন্দমতো কেনাকাটা করে দেবেন। কিন্তু অন্য সবার মতো সেদিনের আগুনে মারা যায় গোলাম রাব্বানী।

ঈদের বেতন–বোনাস পেয়ে প্রতি ঈদে সন্তানদের জন্য নতুন পোশাক নিয়ে একসঙ্গে বাড়ি যেতেন নাজমা ও কুদ্দুস দম্পতি। তবে এবার স্বামীকে হারিয়ে ঈদের সব পরিকল্পনা হারিয়ে গেছে নাজমা বেগমের। কখনো টিনশেড রুমের দরজায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকছেন, কখনো স্বামীর ছবি দেখে দেখে অঝোরে কাঁদছেন। ১৭ দিন জীবন–মৃত্যুর লড়াই শেষে গত ৩০ মার্চ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনি।

৯ বছরের ছেলে সোলায়মানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা রানী আক্তার। ভাড়াবাড়ির টিনের ঘরের সামনে বসে আছেন বাকরুদ্ধ হয়ে। ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন। ছেলের সঙ্গে শেষ কী কথা হয়েছিল, জানতে চাইলে সেদিনের কথা মনে করে বিলাপ করতে করতে রানী আক্তার বলেন, ‘পুতে কইছিল আম্মা ঈদের মার্কেট করতা না তুমি। আমি কইছিলাম বাবা ছুটি হোক তহন মার্কেট করুম। তোমরা আমার পুতরে ফিরাইয়া আইনা দেও। ওরে কত দিন ধইরা দেহি না।’

ইউএনও মোহাম্মদ কাউছার আহাম্মেদ জানান, এখনো দগ্ধদের খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।