নিষিদ্ধ করার পরেও মহাদেও নদ থেকে বালু উত্তোলন
নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার মহাদেও নদ থেকে প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র ১০ দিন ধরে বালু উত্তোলন করছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন। প্রতি রাতে দেড় শতাধিক ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকায় খনন যন্ত্র বসিয়ে এসব বালু তোলা হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও সাংবাদিকদের নাম ব্যবহার করে প্রতিটি নৌকা থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।
কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসাদুজ্জামান বলেন, মহাদেও নদ থেকে একটি চক্র প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে বালু উত্তোলন ও চাঁদা আদায় করার খবর পেয়ে অভিযান চালিয়ে চারজনকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়েছে। গত বুধবার রাতে অভিযান চালিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঘনফুট বালু জব্দ করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মহাদেও নদের ওমরগাঁও, হাসানোয়াগাঁও এবং বিশাউতি মৌজায় ৩৫ দশমিক ১৫ একর বালুমহাল জেলা প্রশাসনের ইজারাভুক্ত ছিল। কিন্তু ইজারা দেওয়া নির্দিষ্ট জায়গায় বালু না থাকায় প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ভারতের মেঘালয় সীমান্তবর্তী পর্যটন এলাকাখ্যাত মহাদেও, সন্ন্যাসীপাড়া, চিকনটুপ, বড়ুয়াকোনা, পাতলাবনসহ নদের বিভিন্ন এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন করেন ইজারাদাররা। এতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্টের পাশাপাশি নদের তীরের বাড়িঘর, বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বেশ কিছু স্থাপনা ভাঙার উপক্রম হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) বালুমহালের ইজারা-সংক্রান্ত সব কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল রিট করে। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ১৩ জুন হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন।
রুলে মহাদেও নদ, নদ-সংলগ্ন ফসলি জমি, স্থানীয় বাজার, বসতবাড়ি, বাগান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বৃক্ষাদি রক্ষার ব্যর্থতা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ও জনস্বার্থবিরোধী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে মহাদেও নদের অবস্থা সম্পর্কে আদালতে প্রতিবেদন দিতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ বিবাদীদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালতের আদেশের পর ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর এক চিঠির মাধ্যমে মহাদেও নদ থেকে বালু উত্তোলন-সংক্রান্ত ইজারা বাতিল করা হয়। এর পর থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে কোনো ধরনের হাইড্রোগ্রাফিক ও ভূতাত্ত্বিক জরিপ, পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাব নিরূপণ না করেই জেলা প্রশাসন গত ২৮ জানুয়ারি মহাদেও নদের বালুমহাল ইজারার জন্য দরপত্র আহ্বান করলে ইজারা কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে বেলা সম্পূরক এক আবেদন করে।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সম্পূরক আবেদনের শুনানিতে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মহাদেও নদের বালুমহালের ইজারা-সংক্রান্ত সব কার্যক্রম স্থগিত করে দেন। পরে বিভাগীয় কমিশনার আদালতের রায় বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু সম্প্রতি একটি চক্র নদের বিভিন্ন স্থান থেকে সন্ধ্যার পর থেকে ভোর রাত পর্যন্ত বালু উত্তোলন করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে বিক্রি করছে।
কলমাকান্দার রংছাতি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রতন মিয়া, নল্লাপাড়া গ্রামের মৌলা মিয়া, তারেক মিয়াসহ বেশ কয়েকজন বালু তুলছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চক্রটি প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে নৌকাপ্রতি এক হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ আছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে গত সোমবার রাত ১২টার দিকে নদের ডাইয়ারকান্দা বাজার এলাকায় অভিযান চালায় উপজেলা প্রশাসন। পরে সেখান থেকে চার বালু ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। জব্দ করা হয় বালুভর্তি চারটি নৌকা। প্রশাসনের উপস্থিতি টের পেয়ে চাঁদাবাজ চক্রের অন্য লোকজন দৌড়ে পালিয়ে যান। পৃথক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে চার ব্যক্তিকে ৫৪ হাজার টাকা জরিমানা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসাদুজ্জামান ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) শহীদুল ইসলাম।
সোমবার বালু তোলার অপরাধে চারজনকে জরিমানা করা হয়। তাঁরা হলেন কলমাকান্দা উপজেলার কালিহালা গ্রামের মমিন মিয়া, মধ্যনগর উপজেলার বলরামপুর গ্রামের ছানাউল্লাহ, আবদুলল হাকিম ও লাদেন মিয়া। জরিমানাপ্রাপ্ত বালু ব্যবসায়ী মমিন মিয়া বলেন, ‘ইউএনও, পুলিশ আর সাংবাদিকদের নাকি নৌকাপ্রতি টাকা দিতে হয়। তাই রতন, রফিকুল, মৌলাসহ কয়েকজন আমাদের কাছ থেকে নৌকাপ্রতি ১ হাজার টাকা করে চাঁদা নেন। এখন আবার ইউএনও সাব জরিমানা করেছেন। তাহলে আমাদের টাকা দিয়ে কী লাভ হলো?’
জানতে চাইলে ইউপি সদস্য রতন মিয়া বলেন, ‘আমি কারও কাছ থেকে চাঁদা নিই না। অন্য কেউ নিতে পারে।’ অভিযুক্ত অন্যদের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ায় তাঁদের বক্তব্য জানা যায়নি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ বলেন, কলমাকান্দায় কোনো বালুমহাল নেই। মহাদেও বালুঘাট ইজারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই নদ থেকে বালু তোলা বন্ধে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।