কাঞ্চনজঙ্ঘার টানে ভ্রমণে যেতে পারেন পঞ্চগড়ে
ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মৃতিবিজড়িত দেশের সর্বোত্তরের জনপদ পঞ্চগড়। পুণ্ড্র, গুপ্ত, পাল, সেন ও মুসলিম শাসনামলের হাজার বছরের ইতিহাস–ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ জনপদে রয়েছে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। শীতপ্রবণ এই জেলার অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে দিন দিন ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বাড়ছে পঞ্চগড়ের কদর। ‘উত্তরের প্রবেশদ্বার, সবুজ চায়ের সমাহার’ ব্র্যান্ডিংয়ের এই জেলার পাঁচ উপজেলাতেই কমবেশি রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্যসংবলিত নানা স্থাপনা।
অক্টোবর ও নভেম্বর মাস এলেই আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে দেখা মেলে হিমালয় পর্বতমালার তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার। তবে পঞ্চগড়ে পর্যটকেরা শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতেই আসেন না, গায়ে মাখেন আগাম শীতের হাওয়া। শীত শীত আবহাওয়ায় দর্শনার্থীরা ঘুরে দেখেন জেলার আরও কিছু ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান।
পঞ্চগড়ে এসে সর্বোত্তরের উপজেলা তেঁতুলিয়ায় না গেলে যেন অসম্পূর্ণই থেকে যায় পর্যটকদের উত্তরাঞ্চল ভ্রমণ। জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরত্ব তেঁতুলিয়ার। এই তেঁতুলিয়া উপজেলাতেই আছে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনাময় স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা। নিত্যদিন বাংলাবান্ধার জিরো পয়েন্ট (শূন্যরেখা) দেখতে ভিড় লেগে থাকে দর্শনার্থীদের।
তেঁতুলিয়া উপজেলা শহরে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জেলা পরিষদ ডাকবাংলো। এই ডাকবাংলোর পাশ দিয়েই বয়ে গেছে বাংলাদেশ ও ভারতকে বিভক্ত করা মহানন্দা নদী। এই নদীতে শ্রমিকেরা নুড়িপাথর তোলেন।
জেলা শহর থেকে তেঁতুলিয়া যাওয়ার পথে সদর উপজেলার অমরখানা এলাকায় পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের পাশে চাওয়াই নদের ধারে রয়েছে মুক্তাঞ্চল পার্ক। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধমুক্ত থাকা এই এলাকা মুক্তাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। স্থানটির স্মৃতি ধরে রাখতে জেলা প্রশাসন সেখানে গড়ে তুলেছে মুক্তাঞ্চল পার্ক। এখানে গেলে পঞ্চগড়ের পাঁচটি গড়ের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন পর্যটকেরা।
পঞ্চগড়ের অনন্য আরেক দিক হলো এখানকার চা–বাগান। দেশে কেবল এখানেই সমতল ভূমিতে চা চাষ করা হয়। জেলার সদর ও তেঁতুলিয়া উপজেলায় সবচেয়ে বেশি দেখা মিলবে চা–বাগানের। এসব চা–বাগানে চা–পাতা তোলার দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। সমতল ভূমির এসব চা–বাগান ঘুরে দিনের একটা সময় কাটিয়ে দিতে পারেন পর্যটকেরা।
পর্যটকদের কাছে পঞ্চগড়ের আকর্ষণীয় জায়গা ও স্থাপনার মধ্যে আছে মোগল স্থাপনা মির্জাপুর শাহী মসজিদ। পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে ঠিক ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে এর অবস্থান। এই মির্জাপুর ইউনিয়নেই আছে বার আউলিয়ার মাজার। এখানেও আসেন অনেক পর্যটক।
বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নে আছে বোদেশ্বরী মন্দির। এ ছাড়া দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নে আছে প্রাচীন মন্দির গোলকধাম। এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত স্থাপনা।
পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নে ভারত সীমান্তঘেঁষা ভিতরগড় এলাকায় আছে দেড় হাজার বছরের পুরোনো সুবিশাল মহারাজার দিঘি। আছে ভিতরগড় দুর্গনগরী। জনশ্রুতি আছে, রাজত্ব পরিচালনার সময় ভিতরগড়ে পৃথু রাজা নির্মাণ করেছিলেন রাজপ্রাসাদ ও মন্দির। খনন করেন একটি বিশাল দিঘি, যা মহারাজার দিঘি নামে পরিচিত। পরে পৃথু রাজা আক্রান্ত হলে মর্যাদা রক্ষায় পরিবার-পরিজনসহ দিঘির পানিতে প্রাণ দেন।
দেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর ‘রকস মিউজিয়াম’ ঘুরতে দেখতে পারেন পর্যটকেরা। জাদুঘরটি জেলা শহরের পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসের দোতলা একটি ভবনে। কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ নাজমুল হক ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে জাদুঘরটি গড়ে তুলেছিলেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দর্শনার্থীরা যাতে এই অঞ্চলের ভূমির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারেন। সেই সঙ্গে এই এলাকার নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহ্যগত পরিচয় তুলে ধরতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এই পাথরের জাদুঘর।