মেহেন্দীগঞ্জের পৌর শহরের পাতারহাট বন্দর। আজ মঙ্গলবার হাটের দিন। কিন্তু হাটের ব্যস্ততা ছাপিয়ে যায় যখন ঢাকা থেকে খবর আসে, শাম্মী আহম্মেদের প্রার্থিতা লিভ টু আপিলেও খারিজ হয়ে গেছে। ততক্ষণে শহরে খণ্ড খণ্ড মহড়া দিয়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদ সদস্য পংকজ নাথের সমর্থকেরা। তাঁদের মুখে স্লোগান, ‘আইয়ো, আইয়ো...।’ স্থানীয় চা-দোকানির কাছে ওই স্লোগানের মানে জিজ্ঞেস করলে তিনি হেসে বললেন, ‘শাম্মীর লোকদের ডাকছে ওরা।’
ততক্ষণে আতঙ্কে যে যাঁর মতো আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। নেতাদের ফোন বন্ধ। অনেকের খোলা থাকলেও ধরছেন না। সকালে পাতারহাট বন্দরে পৌঁছে শাম্মীর ঘনিষ্ঠ এক কর্মীর সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁকে বেশ উদ্বিগ্ন লাগছিল। বলছিলেন, ‘রাতে কেউ ঘুমাইনি। আজ কি–না–কি হয়! আজ আপা (শাম্মী) প্রার্থিতা ফিরে না পেলে আমাদের ওরা এলাকায় থাকতে দেবে না।’
শাম্মী আহম্মেদ এবার মনোনয়ন পাওনের পর এলাকায় শান্তি আইছিল। কিন্তু হের মনোনয়ন বাতিল হওনের পর আবার এমপির (পংকজ) লোকদের দাপট বহাল হয়। জানি না আইজকা (মঙ্গলবার) আদালতে কী হয়! তিনি (শাম্মী) ইলেকশন করতে না পারলে আবার আমগোর এলাকা এমপির লোকগোর হাতেই যাইব।
তখন বেলা পৌনে ১১টা। কথা বলতে বলতে তাঁর ফোন বেজে ওঠে। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে কেউ জানান, শাম্মীর প্রার্থিতা আপিলেও খারিজ হয়ে গেছে। মুহূর্তেই ওই কর্মীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কে দ্রুত কথা থামিয়ে তিনি নিরাপদে চলে যান। এরপর তাঁকে ফোনেও পাওয়া যায়নি। শহরের মোড়ে সাদাপোশাকে অস্ত্রধারী পুলিশ, কোস্টগার্ড সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে।
বরিশাল-৪ (মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলা) আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন দলের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহম্মেদ। দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য পংকজ নাথ। পরে শাম্মীর বিরুদ্ধে পংকজ দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগ দিলে রিটার্নিং কর্মকর্তা শাম্মীর মনোনয়ন বাতিল করেন।
পরে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও উচ্চ আদালতে আপিল করেও প্রার্থিতা ফিরে পাননি শাম্মী আহমেদ। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে গিয়ে ১৯ ডিসেম্বর ‘নো অর্ডার’ পান শাম্মী আহমেদ। এ অবস্থায় প্রার্থিতা ফিরে পাওয়াসহ প্রতীক বরাদ্দের নির্দেশনা চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেছিলেন তিনি। আজ প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের বেঞ্চে আপিলটি খারিজ হয়ে যায়।
আজ সকালে লঞ্চে মেহেন্দীগঞ্জ স্টিমার ঘাটে নেমে রিকশায় পাতারহাট বন্দরে যেতে যেতে রিকশাচালক রুবেল সরদারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বললেন, ‘শাম্মী আহম্মেদ এবার মনোনয়ন পাওনের পর এলাকায় শান্তি আইছিল। কিন্তু হের মনোনয়ন বাতিল হওনের পর আবার এমপির (পংকজ) লোকদের দাপট বহাল হয়। জানি না আইজকা (মঙ্গলবার) আদালতে কী হয়! তিনি (শাম্মী) ইলেকশন করতে না পারলে আবার আমাগোর এলাকা এমপির লোকগোর হাতেই যাইব।’ শুধু রুবেলই নন; পাতারহাট বন্দরের অনেকের সঙ্গে কথা বলেই এমন উৎকণ্ঠার কথা জানা গেল।
দলীয় নেতা-কর্মী ও ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৪ আসনের দুই উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সাংগঠনিক উপজেলা কাজীরহাটের নেতা-কর্মীরা আগে থেকেই সংসদ সদস্য পংকজ নাথের বিরুদ্ধে এককাট্টা। তাঁদের অভিযোগ, পংকজ নাথ দল বাদ দিয়ে নিজের লোকদের নিয়ে একটি বলয় তৈরি করে বিভিন্ন ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী করে হারিয়েছেন। এসব দ্বন্দ্বে ১০ বছরে অন্তত ১১ জন দলীয় নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আওয়ামী লীগের সব পদ থেকে পংকজ নাথকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, পংকজকে অব্যাহতি দেওয়ার পর এলাকার রাজনীতিতে সক্রিয় হন শাম্মী আহম্মেদ। শাম্মীর বাবা প্রয়াত মহিউদ্দীন আহম্মেদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কয়েকবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। শাম্মী এলাকার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর তিনটি উপজেলায় নেতা-কর্মীরা তাঁর পক্ষে এককাট্টা হয়ে পংকজকে ঠেকাতে মাঠে নামেন। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার মধ্য দিয়ে সফলও হয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু পংকজ নাথ তাঁর বিরুদ্ধে দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগ তুলে শাম্মীর সেই অগ্রযাত্রা মাঝপথে থামিয়ে দেন।
এখন কী করবেন নেতারা
শাম্মীর প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার পর থেকে তিন উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলে আসছিলেন, শাম্মী প্রার্থিতা ফিরে না পেলেও দলের কেউ পংকজের পক্ষে মাঠে নামবেন না। আজ দুপুরে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র কামাল উদ্দীন খানের বাড়িতে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। ফোনেও সাড়া মেলেনি। হিজলা উপজেলা সভাপতি সুলতান মাহমুদের ফোন বন্ধ।
মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও শাম্মীর স্বজন সৈয়দ মনির বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, আপিল খারিজ হওয়ার পর দুপুর থেকে মেহেন্দীগঞ্জে নেতা-কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা-হুমকি দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিকেলে শ্রীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহমুদ ব্যাপারীর বাড়িতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঘেরাও করে হুমকি দেওয়া হয়েছে। নেতা-কর্মীরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তিনি বলেন, পংকজ নাথকে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন দলের কেউ নন। তাঁর পক্ষে মাঠে নামার প্রশ্নই ওঠে না।
বরিশাল-৪ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মিজানুর রহমান। শাম্মী আহম্মেদের প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় এখন তিনিই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে এলাকায় শক্ত অবস্থান না থাকায় পংকজ নাথের সমর্থকেরা এখন পুরো মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে পংকজ নাথের ঘনিষ্ঠ উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য সুভাষ চন্দ্র সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকতে চাই। পংকজ নাথ দলের বাইরের কেউ নন। আমরা আওয়ামী লীগের সবাইকে নিয়েই ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে চাই। পংকজ নাথ এমন নির্দেশনাই আমাদের দিয়েছেন।’ হামলা-হুমকির বিষয়ে বলেন, পংকজ নাথ সমর্থকদের ফোন করে সবাইকে শান্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপরও যদি কেউ এমন করেন, তাহলে সেই কাজের সমর্থন দেবেন না তাঁরা।
বিকেলে নদীবেষ্টিত মেহেন্দীগঞ্জ থেকে ফেরার সময় বেশ কয়েকজন ফোনে তাঁদের বাড়িতে হামলা ও ভয়ভীতি দেখানোর কথা বলছিলেন। রিকশায় করে স্টিমার ঘাটে ফেরার সময় রিকশাচালক বেল্লাল ব্যাপারী আলোচনা শুনে বলছিলেন, ‘জানি না, এমুন অবস্থা আর কয়দিন চলব, ভয় লাগে আমগো।’