খুলনায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে সরকারি হিসাবে প্রায় ৭৭ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২১ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং ৫৬ হাজার ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ঝড়ে খুলনার বটিয়াঘাটায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। আজ সোমবার বিকেল চারটার দিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত খুলনা শহর এবং উপকূলীয় উপজেলাতে দমকা হাওয়াসহ মাঝারি ও ভারী বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে অনেক জায়গায় বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। কিছু কিছু জায়গায় পানি ঢোকা বন্ধ করতে পারলেও বড় ভাঙার জায়গাগুলো আটকানো সম্ভব হয়নি।
এদিকে রিমালের প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়া ও টানা বৃষ্টিতে জেলার কয়েকটি নদ-নদীর পানি ৫ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের পানির চাপে বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে পাশাপাশি অনেক বাঁধের ওপর দিয়ে পানি উপচে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এরই মধ্যে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে হাজারো পরিবার। ভেসে গেছে অনেক মাছের ঘের। আমেরও ক্ষতি হয়েছে। তবে মাছের ক্ষয়ক্ষতির পারিমাণ এখনো জেলা মৎস্য অফিস থেকে পাওয়া যায়নি।
রিমালের প্রভাবে বটিয়াঘাটা উপজেলায় প্রবল বাতাস ও বৃষ্টিতে গাছ উপড়ে ঘরের ওপর পড়ে লালচাঁদ মোড়ল (৩৬) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে রিমালের প্রভাবে দাকোপ উপজেলায় শিবসা ও ঢাকী নদীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধ ভেঙে তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনীবাসিয়া গ্রামের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা তলিয়ে যায়। স্থানীয়দের স্বেচ্ছাশ্রমে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের কিছু অংশ মেরামত করা গেলেও মূল ভাঙার জায়গা বাঁধা যায়নি।
তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ক্ষীতিশ গোলদার আজ বেলা পাঁচটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, তিন-চারটি জায়গায় এলাকার মানুষ নিয়ে রিং বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সেখানে পানি ঢোকা বন্ধ হয়েছে। তবে মূল ভাঙার জায়গা আস্তে আস্তে চওড়া ও গভীর হচ্ছে। প্রথমে ৩০ হাতের মতো জায়গা বিলীন হয়ে গিয়েছিল দুপুরের পর সেটা আরও অনেকটা বেড়ে গেছে। রাতের জোয়ারে ভাঙার অংশ আরও বড় হবে। আবার রাত থেকে বিদ্যুৎ না থাকায় যোগাযোগ রক্ষা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কামিনীবাসিয়ার মতো দাকোপের খলিশা, পানখালী ও বটবুনিয়া এবং কয়রার দশালিয়ায় বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৬৮ ইউনিয়ন, দুটো পৌরসভা, সিটি করপোরেশন দুটো ওয়ার্ড এলাকায় রিমালের প্রভাব পড়েছে। এতে দুর্গত মানুষের সংখ্যা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার মানুষ। ১ লাখ ৩৩ হাজার লোককে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিল।
দাকোপের সুতারখালী গ্রামে সাবেক ইউপি সদস্য কৃষ্ণপদ মণ্ডল (৭৫) প্রথম আলোকে বলেন, এত দীর্ঘ সময় ধরে ঝড় এর আগে কখনো দেখিনি। রাতে যখন ১০ নম্বর মহাবিপৎসকেত ছিল, তখন যে পরিস্থিতি হয়েছিল, এখন সংকেত কমিয়ে ৩ নম্বরে আনার পর পরিস্থিতি যেন আরও খারাপ হচ্ছে। বাতাসের গতি ও বৃষ্টির পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে। যাঁরা রাতেও আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার কথা চিন্তা করেননি, এখন তাঁদের অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাচ্ছেন।
এ অঞ্চলের মানুষের কাছে সংকেতের হিসেবে মেলানো বরাবরই কষ্টকর বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, রিমালের প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ ফুট উঁচু জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে খুলনার দাকোপ ও কয়রা উপজেলার ৫টি স্থান ভেঙে গেছে। পাইকগাছা উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে বাঁধ না ভাঙলে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে।
খুলনা পওর বিভাগ-২–এর নির্বাহী প্রকৌশলী নির্বাহী মো. আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দাকোপের খলিশা, পানখালী, বটবুনিয়া ও কামিনিবাসিয়া এবং কয়রার দশালিয়া বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এই ৫টি জায়গা মিলে ১৫০ মিটারের মতো বাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। দাকোপ, বটিয়াঘাটা, কয়রা ও পাইকগাছায় আরও ৬০টা পয়েন্টে পানি উপচে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাইকগাছায় অনেক জায়গায় ওভার ফ্লো হয়েছে। সব মিলিয়ে এরই মধ্যে ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনও জোরে বাতাস হচ্ছে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আবদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, দুর্গতদের আমরা সার্বিক সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি। আজকের মধ্যে কিছু উপজেলায় নগদ টাকা পাঠানো হবে। তবে উপজেলা থেকে পাঠানো তথ্যমতে ৪০টির মতো জায়গা দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। এটাই সবচেয়ে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।