পানির ওপর বেঞ্চ বসিয়ে কেন্দ্রে গেলেন পরীক্ষার্থীরা
‘বাড়িতে কোমরসমান পানি। গত বুধবার থেকে এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। খাবার পানির সংকট। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া ও ঘুমাতে পারছি না। পড়াশোনার করারও সুযোগ নেই। অনেক কষ্টে পানি ভেঙে পরীক্ষা দিতে আসছি।’ কথাগুলো বলছিলেন এইচএসসি পরীক্ষার্থী আবদুর রাজ্জাক। তিনি জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার বেলগাছা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বিএম কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিচ্ছেন।
আবদুর রাজ্জাকের মতো অনেক পরীক্ষার্থী এই পরিস্থিতির মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। জামালপুরের ৫টি উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে। এর মধ্যে ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুটি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার ১ লাখ ৩ হাজার ৬৮০ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে দুটি উপজেলা থেকে ৬ হাজার ১৫৪ জন এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। দুটি উপজেলার ১২টি কেন্দ্রে তাঁরা পরীক্ষা দিচ্ছেন।
পরীক্ষার্থী আবদুর রাজ্জাকের বাড়ি ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি এলাকায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সকাল আটটার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়েছি। বাড়ির উঠানে কোমরসমান পানি। ঘরের ভেতর পানি। কোথাও পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে, আবার কোথাও সাঁতার দিয়ে আসছি। গায়ের কাপড় ভিজে গেছে। ব্যাগের মধ্যে লুঙ্গি আনছিলাম। কেন্দ্রের সামনে এসে ভেজা কাপড় খুলে লুঙ্গি পরলাম। লুঙ্গি পরেই পরীক্ষা দেব। কেমন পরীক্ষা হবে, জানি না।’
আজ রোববার সকাল নয়টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, ইসলামপুরের বেলগাছা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বিএম কলেজ কেন্দ্রের প্রধান ফটকে হাঁটুপানি। কেন্দ্রের ভেতরে কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরসমান পানি। পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষাকেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পানির কারণে তাঁরা কেন্দ্রের ভেতরে যেতে পারছেন না। পরে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রধান ফটক থেকে পানির ওপর বেঞ্চ বসিয়ে দেন। এর ওপর দিয়ে পরীক্ষার্থীরা কক্ষের ভেতর প্রবেশ করেন।
একই অবস্থায় গুঠাইল হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের। এই কেন্দ্রের মাঠে হাঁটুপানি। অনেক কষ্টে পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে প্রবেশ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘ইসলামপুর উপজেলার বেশির ভাগ এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এখনো বেশির ভাগ ঘরবাড়িতে পানি রয়েছে। গত কয়েক দিন পড়াশোনা করারই কোনো সুযোগ ছিল না। এর মধ্যেই আজ পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে যেন পরীক্ষাকেন্দ্রে আসছি।’
ইসলামপুরের গুঠাইল হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের কেন্দ্র সচিব আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক দিন বিভিন্ন এলাকা বন্যাকবলিত হয়েছে। এই কেন্দ্রের মাঠেও হাঁটুপানি। এখানে ৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬৩১ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। আজ সবাই উপস্থিত আছেন। বন্যার কারণে হয়তো কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তবে যথাসময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যার পানিতে জেলার ২১৪টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে ৬৩টি মাধ্যমিক ও ১৫১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। জামালপুরে ৪৭টি কেন্দ্রে ২৭ হাজার ৯৯ শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে ইসলামপুর উপজেলায় ৩ হাজার ৮৩ জন ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ৩ হাজার ৭১ জন।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ইসলামপুর উপজেলার ৬টি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। এর মধ্যে দুটি কেন্দ্রের ভেতর পানি রয়েছে। প্রধান গেট থেকে বেঞ্চ দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা করা হয়েছে। পরীক্ষার্থীরা উপস্থিত হয়েছেন এবং ভালোভাবেই পরীক্ষা দিয়েছেন। তবে বন্যাদুর্গত এলাকার বাড়িঘরে এখনো পানি রয়েছে। বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ছাড়া পরীক্ষা বন্ধ রাখার সুযোগ নেই।’
জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে যমুনা নদীর বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কার্যালয়ের পানি পরিমাপক আবদুল মান্নান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ৬ সেন্টিমিটার পানি কমে বিপৎসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পানি কমছে খুব ধীরগতিতে।