হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে ৯ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় যে হত্যা মামলা হয়েছে, তাতে আসামি করা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ করেছেন নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা। অনেকে ঘটনার সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও বিএনপির নেতারা পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশ করে মামলায় তাঁদের নাম ঢুকিয়েছেন বলে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ। এ ছাড়া এজাহারে ঘটনার বিবরণ বদলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এ মামলায় হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক ময়েজ উদ্দিনকে প্রধান আসামি করে ১৬০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৩০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। মামলার অপর আসামিরা হলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও বানিয়াচং উত্তর-পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হায়দারুজ্জামান খান, বানিয়াচং উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন, উপজেলার মন্দরী ইউপির চেয়ারম্যান শেখ শামছুল হক, জেলা যুবলীগের সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরী, বানিয়াচং তোপখানা গ্রামের বাসিন্দা ও যুক্তরাজ্যপ্রবাসী শাহ নেওয়াজ প্রমুখ।
নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা জানান, মামলার আগের দিন নিহত ৯ জনের পরিবারকে জেলা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে নিয়ে যান বিএনপির নেতারা। সেখানে বসেই এ মামলার আসামির তালিকা তৈরি করা হয়। কারা কারা আসামি, এ বিষয়ে তাঁদের ধারণা দেওয়া হয়নি। সেখান থেকে আসার সময় প্রতিটি পরিবারকে পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।
৫ আগস্ট বানিয়াচংয়ে সংঘর্ষে ৯ জন নিহত হন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, ওই দিন দুপুরে উপজেলার এল আর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে জড়ো হন কয়েক শ লোক। পরে তাঁরা একটি মিছিল নিয়ে বড়বাজার হয়ে থানার সামনে দিয়ে রওনা হন। পথে ঈদগাহ এলাকায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী তাঁদের বাধা দেন। এ সময় বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড এবং একপর্যায়ে গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনজন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছয়জনসহ মোট ৯ জন নিহত হন।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন বানিয়াচং উপজেলার পূর্বঘর গ্রামের সাদিকুর (৩০), কামালখানি মহল্লার আকিনুর মিয়া (৩২), যাত্রাপাশা মহল্লার হাসান মিয়া (১২), মাঝের মহল্লার আশরাফুল ইসলাম (১৭), পাড়াগাঁও মহল্লার মোজাক্কির মিয়া (৪০), কামালখানি মহল্লার নয়ন মিয়া (২০), যাতুকর্নপাড়া মহল্লার তোফাজ্জল (১৮), খন্দকার মহল্লার আনাছ মিয়া (১৮) ও সাগরদিঘি এলাকার সোহেল আখঞ্জী (৩৫)।
নিহত ৯ জনের মধ্যে অন্যতম শিশু হাসান মিয়ার (১২) বাবা মো. ছানু মিয়া ২২ আগস্ট দুপুরে বানিয়াচং থানায় মামলাটি করেন। এজাহারে কোথাও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও পুলিশের গুলি ছোড়ার কথাটি নেই। সেখানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গুলি ছোড়েন এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার ৭১ নম্বর আসামি করা হয়েছে বানিয়াচংয়ের সৈদ্যারটুলা গ্রামের আজিজুর রহমানের প্রবাসী ছেলে রুহুল আমিনকে (৩২)। প্রায় আট বছর যাবৎ তিনি ইতালিতে বসবাস করে আসছেন। রুহুল আমিনের বাবা আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে ২০১৬ সাল থেকে ইতালির ভেনিস শহরে বসবাস করছে। সে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে সেখানকার প্রবাসীদের নিয়ে ভেনিস শহরে নানা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। সে কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না। তাকে বানিয়াচংয়ের হত্যা মামলায় কেন আসামি করা হলো, সে বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। তবে আমাদের ধারণা, এলাকার কেউ হয়তো আক্রোশমূলক আমার ছেলেকে এ মামলায় জড়িয়েছে।’
মামলার ১৬ নম্বর আসামি ফুয়াদ উল্লা খান এলাকায় থাকেন না। তিনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা। ফুয়াদ বলেন, ঘটনার দিন তিনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ছিলেন। এর প্রমাণ তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেবেন। তিনি কেন ওই মামলায় আসামি হলেন, তা তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না।
মামলায় ১৩১ নম্বর আসামি দৈনিক সমকালের বানিয়াচং উপজেলা প্রতিনিধি ও হবিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক আমার হবিগঞ্জ পত্রিকার উপসম্পাদক রায়হান উদ্দিন। তিনি ছাড়া এ মামলায় আরও চার গণমাধ্যমকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। তাঁরা এখন এলাকাছাড়া। রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতি করি না। আমার পেশা সাংবাদিকতা। আমাকে কেন এ মামলায় জড়ানো হলো, তা নিয়ে চিন্তায় আছি।’
বানিয়াচং উপজেলা সদরের তুষার স্মৃতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল মনসুর তুহিন। তিনি এ মামলার ৩৪ নম্বর আসামি। চৌধুরী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফজলে উল্লাহ খান এ মামলার ৩৫ নম্বর আসামি। তাঁরা সংঘর্ষ ও আন্দোলনের আশপাশেও ছিলেন না বলে দাবি করেছেন। এখন তাঁরা চাকরি হারানোর ভয়ে আছেন, এমনটিই জানালেন পরিবারের সদস্যরা।
সাবেক সংসদ সদস্য ময়েজ উদ্দিনসহ কয়েকজন দাবি করেন, ৫ আগস্ট ঘটনার দিন পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ওই ৯ জন। এখন এ মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের ফাঁসানো হচ্ছে।
নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলো যা বলছে
নিহত নয়ন মিয়ার (২০) বাবা বেঁচে নেই। তাঁর চাচা খলিলুর রহমান বলেন, ‘এ মামলায় কে আসামি, কারা আসামি, এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। তবে মামলার আগের দিন বাদী ছানু মিয়াসহ আমাদের ৯টি পরিবারকে হবিগঞ্জ জেলা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিএনপির নেতারা আমাদের নিয়ে যান। সেখানে বসেই এ মামলা সাজানো হয়। কারা কারা আসামি, এ বিষয়ে আমাদের ধারণা দেওয়া হয়নি।’
খলিলুর রহমান আরও বলেন, ‘এ মামলার ৬৭ নম্বর আসামি আমার মামাতো ভাই ইউপি সদস্য শহীদ মিয়া। আমরা অবগত থাকলে তো তাঁকে আসামি করতাম না।’ তিনি বলেন, ওই দিন আসার সময় প্রতিটি পরিবারকে পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।
নিহত আশরাফুল (১৭), মোজাক্কির (৪০), তোফাজ্জল (১৮), সাদিকুর (৩০), আকিনুরের (৩২) পরিবারের সদস্যরা জানান, মামলার বাদীকে তাঁরা চেনেন না। তিনি সবার সঙ্গে কথা বলে আসামি দেননি। একজন পুলিশ কর্মকর্তার অফিসে বিএনপির নেতাদের উপস্থিতিতে এ মামলা সাজানো হয় বলে তাঁরাও জানান।
এ বিষয়ে বাদী মো. ছানু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একা মামলা করেননি। ঘটনায় প্রাণ হারানো অপর আটটি পরিবারও জড়িত। তাঁরা একেকজন একেক রকম করে আসামির নাম দিয়েছেন। কে কোন বিবেচনায় দিলেন, সেটি তাঁর জানা নেই।
যোগাযোগ করা হলে হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির নেতা ও দলের সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জি কে গউছ বলেন, ‘এ মামলার বিষয়ে আমার সঙ্গে কেউ কথা বলেননি বা যোগাযোগও করেননি। কে আসামি, কারা আসামি, সে বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। পুলিশের অফিসে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের বিএনপির কেউ নিয়ে থাকলে, তাঁদের নাম আমরাও জানতে চাই। তবে কেউ নিয়ে থাকলে, সেটি ওই নেতাদের ব্যক্তিগত দায়। এর সঙ্গে জেলা বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।’
হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ সার্কেল) পলাশ রঞ্জন দে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি ঠিক এ রকম নয়। আমরা তাঁদের নিয়ে বসছিলাম ঘটনার বিষয়বস্তু বোঝাতে। কারণ, হত্যাকাণ্ডগুলো একইভাবে হয়েছে, ঘটনাস্থলও এক। আসামিরাও এক। তাই একটি মামলায় সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা বিষয়টি সমন্বয় করার জন্য।’ টাকা দেওয়ার বিষয়টি তাঁর জানা নেই বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
৫ আগস্টের সংঘর্ষে ৯ জন নিহতের খবর ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ গ্রামের মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে থানার সামনে জড়ো হন। একপর্যায়ে কয়েক হাজার মানুষ থানা ঘেরাও করেন। শুরু হয় ইটপাটকেল নিক্ষেপ। একপর্যায়ে থানা ভবনে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষুব্ধ জনতা। সেনাবাহিনী ও বিএনপির নেতারা চেষ্টা করেও মধ্যরাত পর্যন্ত তাঁদের সরাতে পারেননি। ক্ষুব্ধ লোকজন দিবাগত রাত দুইটার দিকে সেনাবাহিনীর গাড়ি থেকে ছিনিয়ে নিয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সন্তোষ দাশ চৌধুরীকে পিটিয়ে হত্যা করেন। পরে লাশ থানার সামনে একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখেন। পরদিন বেলা দুইটায় সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই এসআইয়ের লাশটি উদ্ধার করে। এ ঘটনায় পৃথক একটি হত্যা মামলা হয়েছে। ২২ আগস্ট বিকেলে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু হানিফ বাদী হয়ে এ হত্যা মামলা করেন। এতে পাঁচ থেকে ছয় হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।