‘আমরা ত্রাণ চাচ্ছিনে, বারবার ডোবে না এমন টেকসই বাঁধ চাচ্ছি’
খুলনার শিবসা নদীর পানি ভদ্রায় ঢুকতে শুরু করেছে। দ্রুত ফুলে উঠছে ভদ্রার পেট। ভদ্রার তীরে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতে আসা হাজারো মানুষ বাড়িয়ে দিয়েছেন কাজের গতি। জোয়ার আরেকটু বাড়লেই যে আর কাজ করা যাবে না! বাঁধ আটকানো পুরোটা সম্ভব না হলেও কাজ যতটা এগিয়ে রাখা যায়, সেই তাগিদ থেকেই কাজের গতি বাড়ানো।
এদিকে মাথার ওপর ভাদ্রের তেজি রোদ। দরদর করে ঝরা ঘাম পানিতে মিশে একাকার হচ্ছে। গলা শুকিয়ে এলে খাওয়ার পানি পানের কথা বলছেন কেউ কেউ। রাস্তার ওপর রাখা সিলভারের কলস থেকে পানি ঢেলে তৃষ্ণার্থের মুখে এগিয়ে দিচ্ছেন মাঝবয়সী এক নারী। পানি দিয়ে আবার রাস্তায় এসে বসছেন। চোখে সতর্ক দৃষ্টি, কখন আবার কার লাগবে পানি।
এ দৃশ্য খুলনার পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের কালীনগর গ্রামের ভেঙে যাওয়া বাঁধ এলাকায়। গত বৃহস্পতিবার ওই বাঁধ ভেঙে সেখানকার ১৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর পর থেকে ভাঙা বাঁধের পানি আটকাতে অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সেখানকার মানুষ। গত তিন দিনেও পানি আটকানো সম্ভব হয়নি। আজ রোববারও সেখানে কাজ চলছে।
মানুষের মধ্যে পানি বিতরণ করা ওই নারীর নাম কল্পনা মণ্ডল। বাড়ি কালীনগর গ্রামেই। পানি এনেছেন কোথা থেকে জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর এল, বাড়িতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য বড় একটা ট্যাংকি আছে। সেখান থেকেই এনেছেন। পানি ঢোকার পর তাঁদের রান্নাঘর–টয়লেট পড়ে গেছে। থাকার ঘরের মাটির মধ্যে ধসে গেছে। বাড়িতে এখনো হাঁটুসমান পানি। রান্না–খাওয়া বন্ধ।
মাস তিনেক আগে একবার ওই এলাকা ডুবে যায়। কারণ একই—বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢোকা। তখন বিপাকে পড়ে ১১টি গরু বিক্রি করে দেন কল্পনা। এখন গরু নেই, কয়েকটি ছাগল আছে। সেগুলো বাড়িতে রাখতে না পারায় রাস্তায় ছেড়ে রেখেছেন। কল্পনা মণ্ডল বলেন, ‘অবলা প্রাণীগুলো কী খাবে, কী দেব, তা বুঝতে পারছি না।’
গতকাল শনিবার দুপুরে কল্পনা মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলার সময় কাজ ছেড়ে উঠে আসতে শুরু করেছেন মানুষ। আবার পরের দিনের অপেক্ষা। কল্পনার কণ্ঠে তখন আক্ষেপ আর ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা। কল্পনা বললেন, ‘আমার শ্বশুরের ৩৫ বিঘা জমি সব নদীতে খেয়ে ফেলেছে। আমাদের এখন স্বামী ও তাঁর দুই ভাই মিলে সাত বিঘা জমি আছে। জমি চাষ করা, ধানের চারা বড় হয়ে গেছিল। এখন কবে ধান লাগাতে পারব, নাকি পারব না, জানি না।’
নতুন করে যে রিংবাঁধ হচ্ছে, সেদিকে ইশারা করে কল্পনা বললেন, এই যে বাঁধ হচ্ছে, সেটা তাঁদের জায়গার ওপর দিয়ে। এখানে বাওয়ালি, মণ্ডল আর হালদারদের জমি। আগেও জমির ওপর দিয়ে দফায় দফায় রাস্তা গেছে, আবার যাচ্ছে। পরেও বোধ হয় যাবে। ‘এই জমিটুকু ছাড়া আমাদের আর জমি নেই’—কথাটা বলেই চোখের কোণে আসা জল কাপড়ের খুঁট দিয়ে মুছতে লাগলেন।
কল্পনার পাশে বসা চঞ্চলা মণ্ডল বললেন, ‘আমাদের তো এখন কাঁদারই দিন। আমরা ত্রাণ চাচ্ছিনে। বারবার ডোবে না—এমন টেকসই বাঁধ চাচ্ছি।’
চঞ্চলা বলেন, রান্নাঘরের সব চলে গেছে। জ্বালানি সব ভেসে গেছে। দুটো ঘরের কোনো কিছু নেই। ভিটের ওপর জোয়ার–ভাটা খেলছে। এই কয়েক দিন ধরে কোনো রান্না নেই। চিড়া–মুড়ি খেয়ে থাকতে হচ্ছে। দারণিমল্লিক হাইস্কুলের চারতলা বিল্ডিংয়ে এখন তাঁরা থাকছেন। হরিণখোলা, দারণিমল্লিক ও কালীনগর তিন গ্রামের অনেকে ওখানে আছেন। অনেকের থাকার জায়গা হয়নি।
ভেঙে যাওয়া জায়গা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের গ্রাম দুর্গাপুর। তবে এই পানি সেখানেও পৌঁছে গেছে। সেখানকার বাসিন্দা মেরী রানী সরদার বলেন, ‘এখনো হাঁটুজল। সবাই রাস্তার ওপর মাল রেখে তাঁবু দিয়ে ঢেকে রেখেছে।’
প্লাবিত ওই ১৩ গ্রামের অবস্থা একই রকম। তলিয়ে গেছে অসংখ্য মাছের ঘের, ফসলি জমি। ডুবে আছে টয়লেট। ভেঙে পড়েছে অসংখ্য মাটির ঘর। সেখানকার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে কেউ আশ্রয় নিয়েছেন পাকা উঁচু সড়কে, সঙ্গে সড়কে নিয়ে এসেছেন অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আবার কেউ আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। কেউ কেউ থেকে গেছেন পানিবন্দী ঘরেই। রান্না করতে পারছে না বেশির ভাগ পরিবার। যোগাযোগ করা সহজ—এমন জায়গায় ত্রাণ পৌঁছালেও একটু ভেতরের দিকের মানুষের কাছে সেভাবে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। তবে বাঁধ মেরামত করতে স্থানীয় মানুষের পাশপাশি আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর মানুষ স্বেচ্ছায় বাঁধ বাঁধার কাজে অংশ নিচ্ছেন।