ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় জীবিত স্বামীকে মৃত দেখিয়ে করা মামলাটি চাকরির প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে করানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন বাদী কুলসুম বেগম। আজ শুক্রবার সকালে আশুলিয়া থানা হেফাজতে কুলসুম ওই দাবি করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে কক্সবাজার থেকে কুলসুমসহ তিনজনকে আটক করে নিয়ে আসে আশুলিয়া থানার পুলিশ।
এর আগে গত ২৪ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্বামী আল–আমিনকে হত্যার অভিযোগে ঢাকার একটি আদালতে মামলা করেন কুলসুম বেগম। মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও আসামি হিসেবে ১৩০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। পরে ১৩ নভেম্বর আল–আমিন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় গিয়ে নিজের জীবিত থাকার বিষয়টি পুলিশকে জানালে তাঁকে সাভার থানায় আনা হয়। অন্যদিকে মামলা করে আদালতে হাজির হচ্ছিলেন না কুলসুম। পরে তাঁর বিরুদ্ধে সমন জারি করেন আদালত। গতকাল তাঁকে আটক করে পুলিশ।
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, মামলার বাদীসহ আরও দুজনকে কক্সবাজার থেকে আটক করে থানা হেফাজতে আনা হয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির জন্য বাদীকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বাকি দুজনের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
পুলিশি হেফাজতে থাকা কুলসুম (২১) মানিকগঞ্জের ঘিওর থানার সিংজুরী এলাকার আব্দুল খালেকের মেয়ে। অন্য দুজন হলেন মানিকগঞ্জের ঘিওর থানা এলাকার রুহুল আমিন (৬৪) ও শিবালয় থানার টেপড়া এলাকার শফিউদ্দিন (৪০)। রুহুল আমিন ও শফিউদ্দিনের ফাঁদে পড়ে কুলসুম মামলা করেন বলে তিনি দাবি করেন।
কুলসুম বেগম বলেন, তিনি তাঁর স্বামী আল–আমিনের সঙ্গে সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় থাকতেন। ২৮ আগস্ট সিলেট থেকে মানিকগঞ্জে এসে তিনি চাকরির খোঁজ করছিলেন। এর মধ্যে বাসে শফিউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। কথাবার্তার এক পর্যায়ে কুলসুম শফিউদ্দিনকে চাকরির দরকারের কথা জানালে শফিউদ্দিন তাঁকে মুঠোফোন নম্বর দেন। এর কিছুদিন পর তাঁর চাকরি হয়েছে জানিয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ দিতে বলেন শফিউদ্দিন।
কুলসুম দাবি করেন, ওই ঘটনার কিছুদিন পর ঢাকায় নিয়ে ৫ আগস্ট এক ব্যক্তির মারা যাওয়ার ঘটনায় করা মামলায় তাঁকে বাদী করা হয়েছে বলে জানান শফিউদ্দিন ও রুহুল আমিন। নিহত ব্যক্তিকে তাঁর স্বামী হিসেবে সবার কাছে পরিচয় দিতে বলেন। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে নানা ভয়ভীতি দেখান। পরে তিনি আদালতে মারা যাওয়া ব্যক্তি তাঁর স্বামী বলে জবানবন্দি দেন। এর পর থেকে তাঁকে কক্সবাজারে নিয়ে আটকে রাখা হয়। এর মধ্যে তাঁর স্বামী আল–আমিন নিজ থেকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কুলসুমের বোন ফাতেমা কাউকে কিছু জানানো হবে না জানিয়ে কুলসুমকে বাড়ি নিয়ে আসেন। পরে শফিউদ্দিন ও রুহুল আমিন আবার তাঁকে সেখান থেকে কক্সবাজার নিয়ে যান। পরে আশুলিয়া থানা-পুলিশ তাঁদের তিনজনকে ধরে নিয়ে আসে।
কুলসুম বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাকরির লোভ ও ভয় দেখিয়ে আমাকে মামলার বাদী করা হয়েছে। আমি আসামি কাউকে চিনিও না। আমাকে হত্যার জন্য কক্সবাজার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া আমাকে দিয়ে তারা ধর্ষণের ঘটনা সাজিয়ে মামলা করতে চেয়েছিল। কে মারা গেছে, আমি জানিও না।’
ঘটনা অস্বীকার করে থানা হেফাজতে থাকা রুহুল আমিন বলেন, ‘কুলসুমের স্বামী আল–আমিন এমন পরিচয় দিয়ে তাঁরা ( কুলসুম ও এক ব্যক্তি) আমার বাসায় ভাড়া থাকত, হোটেলে কাজ করত। সে ( আল আমিন পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তি) ৫ আগস্ট মারা গেছে। সিলেটের একজন, সে-ও আল–আমিন। সে-ও কুলসুমের স্বামী শুনতেছি। এরা কৌশলী লোক। মানুষজনকে মামলা দিয়া হয়রানি করতেছে। আমি কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত না।’
তবে শফিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসে কুলসুমের সাথে আমার পরিচয় হয়। তার চাকরির প্রয়োজন জানালে মোবাইল নম্বর দিই। চাকরির সুবাদে রুহুল আমিনের সাথে কুলসুমকে পরিচয় করিয়ে দিই। মামলার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’
এদিকে কুলসুমকে হেফাজতে নেওয়ার খবর পেয়ে থানায় আসেন লিয়াকত দেওয়ান নামের এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে ওই মামলার ৫৭ নম্বর আসামি বলে দাবি করেন। মামলার পর নাম প্রত্যাহারের কথা বলে তিনিসহ একাধিক আসামির কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
লিয়াকত দেওয়ান বলেন, ‘আমি ওই মামলার ৫৭ নম্বর আসামি। একটি মাধ্যমে জানতে পারি, এ ঘটনায় রুহুল জড়িত। পরে রুহুলের ছেলে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে একজনের মাধ্যমে জনপ্রতি ২ লাখ টাকা চায়। পরে আমরা ১১ জন মিলে ১৭ লাখ টাকা দিয়েছি। অন্যদের কাছে থেকে আরও ১২-১৩ লাখ টাকা নিয়েছে। আমরা এ ঘটনায় আইনগত পদক্ষেপ নেব।’
এর আগে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন কুলসুম বেগম। পরে মামলাটি ৮ নভেম্বর আশুলিয়া থানায় রেকর্ড করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ৫ আগস্ট সকালে তাঁর স্বামী আল–আমিন আন্দোলনে অংশ নেন। সরকারের পতনের পর বিকেল চারটার দিকে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় বিজয়মিছিলে আল–আমিন ছিলেন। কিন্তু পরাজয় মেনে না নিতে পেরে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্বিচার গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর স্বামী আল–আমিন মারা যান।
মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুছ ছালাম, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানসহ ১৩০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।
তবে ১৩ নভেম্বর মামলার বাদী কুলসুম বেগমের স্বামী আল–আমিন মৌলভীবাজারের জুড়ী থানায় যোগাযোগ করলে পুলিশ তাঁকে নিজের এলাকা দক্ষিণ সুরমা থানায় জানাতে পরামর্শ দেয়। দক্ষিণ সুরমা থানায় এসে পুলিশকে বিস্তারিত জানান আল–আমিন। পুলিশ বিষয়টি আশুলিয়া থানাকে জানায়। পরদিন পুলিশ দক্ষিণ সুরমায় গিয়ে আল–আমিনকে আশুলিয়া থানায় নিয়ে আসে।