রাজশাহী মেডিকেলে লিফটের পর এসি জালিয়াতি, ঠিকাদার একই
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে লিফট স্থাপনে জালিয়াতি করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ব্রাদার্স কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে এবার নকল শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) সরবরাহের অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছয়টি নকল এসি খুলে বারান্দায় ফেলে রেখেছে এবং ঠিকাদারকে আসল এসি সরবরাহ না করা পর্যন্ত নকলগুলো সরাতে দেয়নি।
ঠিকাদার এখন সব এসি পরিবর্তন করে দিতে গড়িমসি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। লিফট জালিয়াতির কারণে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকভুক্ত করতে গতকাল সোমবার স্মারকলিপি দিয়েছে সামাজিক সংগঠন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ।
রামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের নতুন আইসিইউ ইউনিটে দুই টনের গ্রি কোম্পানির মোট ৯টি এসি লাগানোর কথা ছিল। যথারীতি উদ্বোধনের সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসি লাগানো অবস্থায় ইউনিট বুঝে নেয়। কয়েক দিন পর দেখা যায়, এসিগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। তখন তাদের সন্দেহ হয়। এ ব্যাপারে ৩ অক্টোবর হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয়ে এক সভা হয়। সভায় ১ নম্বর আলোচ্যসূচি ছিল ‘আইসিইউ লিফট টেন্ডার স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী হতে হবে’। দ্বিতীয় আলোচ্যসূচি ছিল ‘আইসিইউতে যেসব এসি আছে, সেগুলো অরিজিনাল কি না, চেক করতে হবে’।
সভায় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এফ এম শামীম আহাম্মদ, আইসিইউ ইউনিটের প্রধান আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জরুরি বিভাগের ইনচার্জ শংকর কুমার বিশ্বাস, গণপূর্তের রাজশাহী সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল হক, গণপূর্ত বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু হায়াত মুহাম্মদ শাকিউল আজম, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (ই/এম) জান্নাত-ই-নূর, উপসহকারী প্রকৌশলী (ইমারাত) মো. আরিফ হোসেন, উপসহকারী প্রকৌশলী (ই/এম) আবু সিনা মো. মাসুম, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (ইমারাত) কাউসার সরকার উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানায়, প্রথমে দুটি এসি ঠিকমতো কাজ করছে না দেখে তারা বৈঠক করে এসিগুলো সঠিক কি না, যাচাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিশেষজ্ঞ ডেকে এনে এসিগুলো দেখায়। তারপর তারা নিশ্চিত হয়, ঠিকাদার নকল এসি সরবরাহ করেছেন। তারা জানতে পারে, স্থানীয়ভাবে তৈরি করা এসিতে গ্রি–এর স্টিকার লাগিয়ে হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়েছে। সম্প্রতি তারা ছয়টি এসি খুলে আইসিইউ ইউনিটের বারান্দায় রেখে দিয়েছে এবং স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী এসিগুলো সরবরাহ করতে ঠিকাদারকে বাধ্য করেছে। আরও তিনটি এসি পরিবর্তন করে দেওয়ার কথা কিন্তু ঠিকাদার এই এসিগুলো বদলানোর ব্যাপারে গড়িমসি করছেন।
হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের বারান্দায় গিয়ে দেখা যায়, নকল এসিগুলো খুলে পরে সরবরাহ করা অরিজিনাল এসির প্যাকেটে ভরে বারান্দায় ফেলে রাখা হয়েছে। ঠিকাদার নকল এসিগুলো নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সব এসি বুঝিয়ে না দেওয়ায় কর্তৃপক্ষ নকল এসিগুলো সরাতে দেয়নি।
জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এফ এম শামীম আহাম্মদ মঙ্গলবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, নকলগুলো একটিও ইনস্টল করতে দেওয়া হবে না। নকলগুলো রেখে দেওয়া হয়েছে। সব অরিজিনাল এসি না দেওয়া পর্যন্ত ওগুলো সরাতেও দেওয়া হবে না।
এসিগুলো নকল, এটা প্রথম স্বীকার করতে চাননি গণপূর্ত বিভাগ-২–এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু হায়াত মুহাম্মদ শাকিউল আজম। একপর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন, ওই এসিগুলো খুলে নেওয়া হয়েছে। ভালো এসি দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ব্রাদার্স কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ জাকির হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ধরেননি। এর আগেও একাধিবার ফোন করা হয়েছে, কিন্তু তিনি ফোন ধরেন না।
এর আগে একই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে হাসপাতালের লিফট জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। তিনি লিফট অপসারণ করে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু প্রায় সাত মাস পেরিয়ে গেলেও অরিজিনাল লিফট সরবরাহ না করায় হাসপাতালের রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ জন্য অবিলম্বে ওই ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করার দাবিতে গতকাল সোমবার সকালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়েছে রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ। এই সংগঠনের আশঙ্কা, ঠিকাদার আবার পুরোনো লিফটকে ঘষামাজা করে লাগিয়ে দিতে পারে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, ব্রাদার্স কনস্ট্রাকশন রামেক হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিট নির্মাণের কাজ পায়। ১০ কোটি ৯৫ লাখ ৯০ হাজার টাকার এই কাজের মধ্যে স্মার্ট দরজা লাগানোর কথা ছিল। কিন্তু ঠিকাদার সৈয়দ জাকির হোসেন কাঠের দরজা লাগান। হাসপাতাল থেকে আপত্তি জানালে দরজা তিনটি পরবর্তী সময়ে পাল্টে কাচের করে দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ফায়ার প্রোটেকটেড বেড কাম প্যাসেঞ্জার লিফট লাগানোর কথা ছিল। কিন্তু ঠিকাদার বেড লিফট না লাগিয়ে প্যাসেঞ্জার লিফট লাগিয়ে দেন। ফায়ার প্রোটেকটেড লিফট না দিয়ে সাধারণ লিফট স্থাপন করেন। এই জালিয়াতি ধরা পড়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও গণপূর্তের নির্দেশে ঠিকাদার লিফট খুলে নিয়ে যান। কিন্তু এখনো সেই লিফট লাগাননি।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. জামাত খান প্রথম আলোকে বলেন, ওই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। সাত মাস পার হতে চলেছে এখনো লিফট আসেনি। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, আবার দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ঠিকাদার এদিক-ওদিক করে পুরোনো লিফটই লাগিয়ে দেন কি না। এর মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে এসি জালিয়াতিরও অভিযোগ উঠেছে। তাঁরা যেকোনো মূল্যে ওই জালিয়াতি প্রতিরোধ করবেন। তিনি ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।