অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় হয়েছে ওরা। তিন বেলা খাবারই জোটেনি—পড়াশোনার খরচ আসবে কোত্থেকে। কিন্তু ওরা দমেনি। কেউ ইটভাটায় কাজ করেছে, কেউ টিউশনি করেছে। এভাবে নিজের পড়াশোনার খরচ তো জুগিয়েছেই, সহযোগিতা করেছে পরিবারকে।
এবার এসএসসি পরীক্ষায় রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রাজু মিয়া ও কাইয়ুম আলী, তারাগঞ্জ উপজেলার লিমা আক্তার এবং সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার মো. তাহমিদ আবদুস সবুর জিপিএ–৫ পেয়েছে। তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন অভিভাবকেরাও। তবে দুশ্চিন্তা রয়েছে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন নিয়ে। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আর্থিক অনটন। অদম্য এই মেধাবীরা সেই বাধা ডিঙিয়ে জয়ী হতে চায় জীবনে।
ইটভাটায় কাজ করেছে রাজু
বাবা রফিকুল ইসলাম পেশায় দিনমজুর। অপর দুই ভাইয়ের একজন এইচএসসি পাস করে ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করেন। ছোট ভাইয়ের বয়স দেড় বছর। অভাবের সংসারে বাধ্য হয়ে দিনে ইটভাটায় কাজ করেছে রাজু মিয়া। সন্ধ্যায় করেছে টিউশনি। এভাবে সংগ্রাম করে নিজে পড়াশোনা করেছে। পাশাপাশি পরিবারকে করেছে সহযোগিতা।
রাজু মিয়ার বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার কালুপাড়া ইউনিয়নের জামুবাড়ি ডুগিপাড়া গ্রামে। উপজেলার খামারপাড়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। বিদ্যালয়ের ৩১ পরীক্ষার্থীর মধ্যে রাজু মিয়াই এ সাফল্য পেয়েছে। সে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। রাজুর মা আনজিলা খাতুন বলেন, ছেলেটা খুব পরিশ্রমী। পড়ার প্রতি খুব আগ্রহ। গরিব মানুষ। কিন্তু পড়ানোর টাকা নেই। এই নিয়ে চিন্তায় আছেন।
টিউশনি করে চলেছে তাহমিদের পড়াশোনা
দিনমজুর বাবা মো. দুলাল হোসেন তিন ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ চালাতে পারেন না। ছোট ছেলে মো. তাহমিদ আবদুস সবুর বেশি মেধাবী। বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক সহযোগিতা করতেন তাকে। পাশাপাশি টিউশনি করেছে ছেলেটি।
এভাবে সংগ্রাম করে পড়াশোনা করে পিএসসি এবং জেএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছে তাহমিদ। এ বছর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় সে। তার সাফল্যের ধারা অব্যাহত রয়েছে। নিমগাছী উচ্চবিদ্যালয় থেকে পেয়েছে জিপিএ–৫। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের বাঁশাইল গ্রামে।
উচ্চমাধ্যমিক ভালো কলেজে পড়তে চায় তাহমিদ। স্বপ্ন দেখে চিকিৎসক হয়ে পরিবারের অভাব দূর করার। নিমগাছী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘তাহমিদ মেধাবী ছাত্র। কিন্তু তার ভবিষ্যৎ পড়াশোনার খরচ জোগানো নিয়ে চিন্তিত পরিবার। তাহমিদের স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানাই।’
বই ধার নিয়ে পড়েছে কাইয়ুম
চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে কাইয়ুম আলীর বাবা আবদুল খালেক মারা যান। অভাবের সংসারে চার সন্তান নিয়ে অকূল সাগরে পড়েন মা জোবেদা খাতুন। চার ভাইয়ের মধ্যে ছোট কাইয়ুম। তিন ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন।
সংসারই চলে না, পড়াশোনার খরচ কোথায় পাবে কাইয়ুম। বাধ্য হয়ে বন্ধুদের কাছে বই ধার নিয়ে পড়েছে কাইয়ুম। তবুও থেমে থাকেনি। পাশাপাশি টিউশনি করিয়ে জোগাড় করেছে পড়াশোনার খরচ। এভাবে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার ময়নাকুড়ি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়েছে।
বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কাইয়ুমের বাড়ি উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের ময়নাকুড়ি প্রামাণিকপাড়া গ্রামে। বাড়িতে অসুস্থ মা। টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ তো জোগায়ই, সহায়তা করে সংসারেও। কাইয়ুমের মা জোবেদা খাতুন বলেন, ‘ছেলেটা রাত জেগে পড়ে। কলেজে ভর্তি করার টাকা নাই। আপনারা একটু আমার অসহায় ছেলেটাকে সাহায্য করলে পড়াশোনাটা চালিয়ে নিতে পারবে।’
অভাব ছাপিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে লিমা
তিন বছর বয়সে খেলতে গিয়ে লিমা আক্তারের ডান হাত পুড়ে যায়। মা সেলিনা বেগম তখন অন্যের বাড়িতে কাজে ছিলেন। মেয়ের হাত পোড়ার খবর পেয়ে ছুটে আসেন। গ্রাম্য চিকিৎসক দেখান। তবে ডান হাত দিয়ে কাজ করার শক্তি হারিয়ে ফেলে লিমা। বাঁ হাতেই চলতে থাকে সব কাজ। এমনকি পড়ালেখাও করেছে বাঁ হাতে।
এখানেই সংগ্রামের শেষ নয়। বাবা বাবুল হোসেন দিনমজুর। একার আয়ে চলে ছয় সদস্যের সংসার। যেদিন তিনি কাজ পান চুলায় রান্নার হাঁড়ি ওঠে, না পেলে থাকতে হয় উপোস। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্রী নয় লিমা। গ্রামের শিশুদের টিউশনি করিয়ে ও মায়ের মুষ্টিচালে পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছে।
লিমার বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের দক্ষিণ নারায়ণজন জলুবার গ্রামে। সে এ বছর বরাতি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় দিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল লিমা। তার বাবা বাবুল হোসেন বলেন, ‘বেটিটা ভালো রেজাল্ট করছে, ভালো কলেজোত ভর্তি হবার নাগবে। কিন্তু ওক কলেজত পড়ার খরচ মুই কোনটে পাইম কন? রেজাল্ট বেরার দিন থাকি ছাওয়াটার কলেজোত ভর্তি নিয়া মনটা খুব বেজার।’
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি, বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ, রংপুর এবং রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ]