২১ বছর ধরে নিখোঁজ মতিউরের ফেরা হলো না, বাড়িতে নেই ঈদ আনন্দ
নিখোঁজ ছেলে ভারত থেকে বাড়ি ফিরবে—এ নিয়ে সহিদুল ইসলাম ও মর্জিনা বেগম দম্পতি কী যে খুশি! ২১ বছর পর ছেলেকে ফিরে পাওয়ার খবর তাঁদের ঈদের আনন্দ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢোকার জন্য ছেলে মতিউরের একটি অনুমতিপত্র (এক্সিট পারমিট) না থাকায় শেষমেশ দেশে ফেরা হয়নি তাঁর। আর এতেই ঈদের আনন্দটাই মাটি হয়ে যায় সহিদুল আর মর্জিনার।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আখানগর ইউনিয়নের দক্ষিণ ঝারগাঁও দেবীডাঙ্গা গ্রামের সহিদুল ইসলাম ও মর্জিনা বেগম দম্পতির বড় ছেলে মো. মতিউর রহমান। ২০০২ সালে ১৫ বছর বয়সে তিনি হারিয়ে যান। ২০১৯ সালের জুনে র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পাওয়া ভারতের শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের কর্মীরা ভারতের মহারাষ্ট্রের কারজাত এলাকার রাস্তা থেকে মতিউরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় উদ্ধার করেন। সেখানকার চিকিৎসকেরা তাঁকে সম্ভাব্য সিজোফ্রেনিয়ার রোগী হিসেবে শনাক্ত করেন। চিকিৎসার একপর্যায়ে চিকিৎসকেরা জানতে পারেন, তাঁর বাড়ি বাংলাদেশে। পরে ২৭ জুন মতিউরকে বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে মতিউরদের বাড়ির ফটকে দেখা হলো সহিদুল ইসলামের সঙ্গে। গোমড়া মুখে বললেন, ‘বাবা, আমাদের আর ঈদ নাই। ভাবছিলাম ছোয়াটাক (ছেলেকে) নিয়ে আনন্দে এবারের ঈদ করব। কিন্তু ওকে ফিরে না পাওয়ায় সব আনন্দ শেষ হয়ে গেছে।’
বাড়ির উঠানের পাশে রান্না ঘর। সেখানে উদাসীন হয়ে বসে আছেন মর্জিনা বেগম। এই প্রতিবেদকের কণ্ঠ শুনে ঘোর কাটে তাঁর। কী রান্না করছেন, প্রশ্ন করতেই চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। আঁচলে চোখ মুছে বললেন, ‘ছোয়াটা গরুর গোশত আর পোলাও খুব পছন্দ করত। উইঠে (ভারতে) কি ওইলা খাবার জুটিছে? বাড়িত আসিবে শুনিয়া পোলাও, সেমাইয়ের ব্যবস্থা করিনু। কিন্তু ছোয়াটাক ফিরে পানুনি।’
মতিউরের পছন্দের সেসব খাবার রেখে দিয়েছেন বলতে বলতে আবারও চোখের কোণ দিকে পানি ঝরে পড়ল। মর্জিনা জানালেন, গত মঙ্গলবার মতিউরকে তাঁদের কাছে তুলে দেওয়ার কথা ছিল। সেদিন সকালে মেয়ে (মতিউরের বোন) গরুর মাংস রান্না করে এনেছিলেন। সেই মাংস সেভাবেই পড়ে আছে।
মতিউর নিখোঁজ হওয়ার বছর চার পর জন্ম হয় তাঁর মামাত ভাই নাইম হাসানের। এত দিন নাইম স্বজনদের মুখেই মতিউরের কথা শুনে আসছিলেন। খোঁজ পাওয়ার পর নাইমের সঙ্গে ভিডিও কলে মতিউরের কথা হতো। নাইম বললেন, ‘ভাইয়াকে সরাসরি দেখিনি। তাঁকে আনতে সীমান্তে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এত বছর পর ভাইয়াকে নিয়ে আনন্দে ঈদ করব। কিন্তু ভাইয়াকে ফেরত পেলাম না। এ নিয়ে পরিবারে ঈদের আনন্দ নাই।’
ফেরার পথে সহিদুল ইসলাম বললেন, ‘কাগজ কম থাকায় মতিউরকে ফেরত দেওয়া হয়নি। শুনেছি ওকে মুম্বাই নিয়ে গেছে। ২০ দিনের মধ্যে মতিউরকে ফেরত দেওয়া হবে। আমরা ওর ফেরতের আশায় আছি।’
২৭ জুন মতিউর রহমান দেশে ফিরছেন—এ তথ্য জানা গেছে র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পাওয়া ভারতের শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ভরত ভাটওয়ানির পাঠানো একটি ই-মেইল থেকে। ওই ই-মেইল তিনি পাঠিয়েছেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, আইসিডিডিআরবির (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরিসহ ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পাওয়া বাংলাদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। ভরত ভাটওয়ানির চিঠিতে কোথায়, কীভাবে মতিউর রহমানকে উদ্ধার করা হয়েছিল, কীভাবে তাঁর চিকিৎসা হয়েছিল, সেই বর্ণনা আছে।
ই–মেইলে বলা হয়, পবিত্র ঈদুল আজহা আগামী বৃহস্পতিবার। এর দুই দিন আগে মতিউরকে ফিরে পাচ্ছেন তাঁর মা-বাবা ও স্বজনেরা। ঈদের ঠিক আগে এই পুনর্মিলন কতটা আনন্দের হবে, সে কথাও চিঠিতে লিখেছিলেন ভরত ভাটওয়ানি।