মারা যাওয়া গফরগাঁওয়ের তিনজনের বাড়িতে মাতম, লাশের অপেক্ষা

সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ইকরামের স্বজনেরা তাঁর লাশের অপেক্ষায় আছেন। বুধবার সকালে গফরগাঁও উপজেলার নিগুয়ারি ইউনিয়নের কুরচাই গ্রামেছবি: প্রথম আলো

সৌদি আরবে পৃথক দুর্ঘটনায় ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের তিন প্রবাসী শ্রমিক মারা গেছেন। নিজেদের ভাগ্যবদলের আশায় তাঁরা বিদেশে গিয়েছিলেন। তাঁদের মৃত্যুতে পরিবারগুলোতে চলছে মাতম। এখন স্বজনেরা লাশের অপেক্ষায় আছেন।

মারা যাওয়া তিনজনের মধ্যে ২১ ডিসেম্বর সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন এবং ২২ ডিসেম্বর গাড়িতে হাওয়া দেওয়ার সময় বিস্ফোরণে একজনের মৃত্যু হয়। সড়ক দুর্ঘটনার মারা যাওয়া দুজন হলেন গফরগাঁওয়ের পাগলা থানা এলাকার নিগুয়ারি ইউনিয়নের কুরচাই গ্রামের আবু সাঈদের ছেলে ইকরাম হোসেন (২৪) ও লংগাইর ইউনিয়নের গোলাবাড়ি গ্রামের রাজমিস্ত্রি খোকা মিয়ার ছেলে মো. রিফাত (২১)। আর বিস্ফোরণে মারা যান উপজেলার পাইথল গ্রামের বদরুদ্দিন তোতা মিয়ার ছেলে সুমন মিয়া (৩৮)।

গফরগাঁওয়ের পাগলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফেরদৌস আলম বলেন, ২১ ডিসেম্বর সৌদির স্থানীয় সময় বেলা ১১টার দিকে মদিনা শহরে সড়ক দুর্ঘটনায় চারজন বাংলাদেশি শ্রমিক নিহত হন বলে গতকাল খবর পান। তাঁদের মধ্যে দুজন তাঁর থানা এলাকার বাসিন্দা। আর ২২ ডিসেম্বর এক শ্রমিক গাড়িতে হাওয়া দেওয়ার সময় মারা গেছেন বলে তথ্য পেয়েছেন।

এক বছরের মাথায় ইকরামের মৃত্যু

মদিনায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ইকরামের বাড়ি গফরগাঁওয়ের নিগুয়ারি ইউনিয়নের কুরচাই গ্রামে। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন ইকরাম। সড়কে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন তিনি। ২১ ডিসেম্বরে কাজ শেষে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় নিহত হন তিনি।

ইকরামের ছোট বোন কোহিনূর বেগম জানান, তাঁর দুই ভাই সৌদি আরবের দুই প্রান্তে থাকেন। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার খবর পেয়ে বড় ভাই ইলিয়াস হোসেন গিয়ে ছোট ভাইকে শনাক্ত করেন। গত বছরের ২২ ডিসেম্বর বিদেশে গিয়েছিলেন। ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাঁরা মৃত্যুর খবর পান।

সৌদিতে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া গফরগাঁওয়ের সুমন মিয়া (বায়ে), মো. রিফাত (মাঝে) ও ইকরাম হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

ইমরানের স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার তিন বছর বয়সী ছেলে মমিনুল ইসলামকে নিয়ে পড়েছেন অথই সাগরে। আজ বুধবার দুপুরে ইকরামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় স্বজনদের ভিড়। মাটির ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তাঁর স্ত্রী সুমাইয়া। তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে দাবি, দ্রুত যেন লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা করে। বাড়ির পাশেই কবর দেব, স্বামীর কবর দেখে বাকি জীবন কাটাতে চাই। স্বামী বলেছিল, এক বছর পর দেশে ফিরে ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করাবে। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা গেছে।’

ঋণের টাকায় বিদেশ গিয়ে লাশ

গফরগাঁওয়ের লংগাইর ইউনিয়নের গোলাবাড়ি গ্রামের রাজমিস্ত্রি খোকা মিয়ার ছেলে মো. রিফাত। দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন রিফাত। স্বজনেরা জানান, ২০২২ সালে স্থানীয় একটি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন রিফাত। কলেজে ভর্তি না হয়ে ভাগ্য বদলের আশায় সৌদি আরবে যান। সড়কের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর বড় ভাই রিয়াদ হাসানও থাকেন মদিনায়। ৫ লাখ টাকা দাদনে ও ২ লাখ টাকা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে প্রবাসে যান রিফাত। প্রতি মাসে এনজিওর কিস্তি ২০ হাজার টাকা ও দাদনে নেওয়া প্রতি লাখের বিপরীতে বছরে ৩০ হাজার টাকা সুদ দিতে হয়। টাকা পরিশোধের আগেই রিফাত মারা যান।

আজ বিকেলে রিফাতের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় বাবা খোকা মিয়া ও মা আছিয়া খাতুনের সঙ্গে। সন্তান হারিয়ে দুজনেই হতবাক। খোকা মিয়া বলেন, ‘ভাগ্য বদলের আশায় ঋণ করে পোলারে বিদেশ পাঠাইলাম। কিন্তু পোলাও চাইল্যা গেল, ঋণও রয়ে গেল। এই ঋণের টেহা এহন দিবাম কিবায়?’ মা আছিয়া খাতুন বলেন, ‘আমার তো সবই গেল। অহন আমার পোলার লাশ কবে পাইবাম?’

সন্তানকে দেখা হলো না সুমনের

সাত বছর ধরে সৌদি আরবের মক্কায় একটি গ্যারেজে শ্রমিকের কাজ করতেন সুমন মিয়া (৩৭)। গফরগাঁও উপজেলার পাইথল গ্রামের এই বাসিন্দা তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন।

স্বজনেরা জানান, সুমন ১২ বছর মালদ্বীপে ছিলেন। আট বছর আগে মক্কায় যান। সেখান থেকে সাত বছর পর গত বছর জুনে দেশে এসেছিলেন। ছুটি শেষে নভেম্বরে আবার প্রবাসে চলে যান। সুমন মিয়ার ফয়সাল আহমেদ (৭) ও ছয় মাস বয়সী আবদুল্লাহ আল তামিম নামের দুই সন্তান আছে। ছয় মাস বয়সী সন্তানকে দেখা হয়নি বাবা সুমনের। কথা ছিল আগামী বছর দেশে ফিরে ছেলেকে দেখবেন। গত ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গ্যারেজে একটি গাড়িতে হাওয়া দেওয়ার সময় চাকা বিস্ফোরিত হয়ে তিনি গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়।

আজ দুপুরে সুমনের বাড়িতে দেখা যায়, স্বজনেরা আহাজারি করছেন। বাবা বদর উদ্দিন একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর। বলেন, ‘ছেলের লাশের অপেক্ষায় আছি। আমার আগে একমাত্র ছেলে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে কোনো দিন ভাবিনি।’

সুমনের স্ত্রী সনিয়া আক্তার স্বামীর মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, দুই সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়ানোর ইচ্ছা ছিল স্বামীর। বড় ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে। কথা ছিল ছোট ছেলেকে দেখতে আগামী বছর দেশে আসবেন। কিন্তু সাগরে ভাসিয়ে গেল তাঁদের। এখন তাঁরা লাশের অপেক্ষায় আছেন।