জেলের আক্ষেপ ‘অভাবে ছেলেটারে পড়াইতে পাইলাম না, এহন রাজমিস্ত্রির কামে দিছি’
জামালপুরে একসময়ের খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র এখন প্রায় মরা নদে পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থাতে নদের একটি অংশে কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও খালি গায়ে মাছ ধরছিলেন হানিফ উদ্দিন (৪৭)। একের পর এক জাল ফেলেও তেমন মাছ পাচ্ছিলেন না। মাঝেমধ্যে জালে কেবল ধরা পড়ছিল ছোট আকারের দু-একটি মাছ। এসব মাছ বিক্রি করেই কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন হানিফ। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি এ পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন।
গতকাল শনিবার সকালে জামালপুর শহরের পুরাতন ফেরিঘাট এলাকায় এই প্রতিবেদককে নিজের সংগ্রামী জীবনের গল্প শোনান হানিফ। এ গল্পে উঠে আসে নদের অতীত ও বর্তমান চিত্রও।
হানিফ উদ্দিনের বাড়ি জামালপুর শহরের ব্রহ্মপুত্র নদসংলগ্ন বানিয়াবাজার এলাকায়। ভোরের আলো ফুটতেই ঝাঁকি জাল নিয়ে পাশেই নদের পাড়ে যান তিনি। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত মাছ ধরেন। এরপর সেগুলো বিক্রি করেন স্থানীয় বাজারে। পরে পরিবারের জন্য বাজার করে বাড়ি ফেরেন। কিন্তু আগের মতো নদে এখন আর মাছ পাওয়া যায় না।
হানিফ জানান, তাঁর এক ছেলে ও মেয়ে আছে। ১২ বছর আগে বহু কষ্টে মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছেন। তবে অর্থের অভাবে ছেলের লেখাপড়া চালাতে পারেননি। ছেলেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়ে টাকার অভাবে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি করাতে পারেননি। নদে আগের মতো মাছ না পাওয়া যাওয়ায় তাঁর সংসারে এর প্রভাব পড়েছে। ফলে পরিবারটিকে টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। সংসারে বাড়তি আয়ের আশায় লেখাপড়া বন্ধ করে তাঁর ছেলে বর্তমানে রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করছেন।
নদে কুনো দিন ২০০-৩০০ টেহার মাছ পাই; আবার কুনো মাছই পাইনে। যে কয়ডা পাই, ওইগুলাই বাজারে বেইচ্চা চাইল কিনি। এমনে ৫-৭ বছর ধরে চলছে। টাকার অভাবে একমাত্র ছেলেটারে পড়াইতে পাইলাম না। এহন রাজমিস্ত্রির কামে দিছি। কী করুম? জীবনডা তো বাঁচাইতে হইবো।হানিফ উদ্দিন, জেলে
এ প্রসঙ্গে হানিফ বলেন, ‘নদে কুনো দিন ২০০-৩০০ টেহার মাছ পাই; আবার কুনো মাছই পাইনে। যে কয়ডা পাই, ওইগুলাই বাজারে বেইচ্চা চাইল কিনি। এমনে ৫-৭ বছর ধরে চলছে। টাকার অভাবে একমাত্র ছেলেটারে পড়াইতে পাইলাম না। এহন রাজমিস্ত্রির কামে দিছি। কী করুম? জীবনডা তো বাঁচাইতে হইবো।’
সরেজমিনে দেখা যায়, নদটি বর্তমানে মরা একটি খালে রূপ নিয়েছে। মাঝখানের কিছু অংশে কিছু পানি থাকলেও অধিকাংশ স্থানেই পানির দেখা নেই। হানিফ উদ্দিনের ভাষ্য, পরিস্থিতিটা আগে এমন ছিল না। নদের মধ্যে একসময় থই থই পানি ছিল। সব সময় নদে ছোট-বড় নানা প্রজাতির মাছও পাওয়া যেত। এ নদকে ঘিরেই বানিয়াবাজার এলাকার অনেক বাসিন্দাই জীবন-জীবিকা চালিয়েছেন। এখন আর সেই অবস্থা নেই। সারা দিন জাল ফেললেও মাছ পাওয়া যায় না। ফলে অনেকে নিজেদের আদি পেশা পরিবর্তন করেছেন। তবে সেখানেই আটকে আছেন হানিফ।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, আগে শীতকালে নদে পর্যাপ্ত পানি থাকত, এখন আর তা নেই। বরং ভরা বর্ষা মৌসুম পেরোতে না পেরোতেই নদ প্রায় পানিশূন্য হয়ে ওঠে। একসময় ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে হাজারো পরিবার জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেছে। শুষ্ক মৌসুমেও নদে থাকত অথই পানি, দেখা যেত স্রোতও। আর এখন সেসবের প্রায় সবটাই হারিয়ে নদটি খালে পরিণত হয়েছে। সারা দিন নদে জাল ফেলে একজন জেলে এক থেকে দুই কেজির বেশি মাছ পান না।
হানিফ উদ্দিন বলেন, ‘বাপের হাত ধইরা এ নদে মাছ ধরা শুরু করছিলাম। জীবনের অর্ধেক সুময় নদেই কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু নদটি মইরার যাওনের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও কেমন জানি নিঃস্ব হইয়া গেছি। ছোডবেলা থেকেই মাছ ধরাই শিখছি; আর কোনো পেশার সঙ্গে কখনোই যুক্ত হইনি। এহন নদে মাছ না পাওয়ায় জীবন চলছে না, বহু কষ্টে কোনোরকমে বেঁচে আছি। তবে এ নদে একটা সময় বড় বড় বোয়াল, ট্যাংরা, রুই, কাতলা, চিংড়ি, পুঁটি, বাইন, টাকি, মলা, শোল, চিতলসহ নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এখন আর এসব মাছের দেখা মেলে না।’
জীবন-জীবিকা নিয়ে জানতে চাইলে হানিফ বলেন, ‘এখন আর দিন চলে না, বাপু! ওই বিয়ান (সকাল) বেলায় নদীত আইছি। দেহেন (দেখা) বাল্টির (বালতি) তলাও ভরে নাই। ভোর থেকে এখন পর্যন্ত ২৫-৩০ বার পানিতে জাল ফেলছি। দু-একবার কইরে একটা-দুইটা করে বাইলে (বাইলা) মাছ আহে। নদীত আগের মতো মাছ নাই। কিন্তু ডাইল-ভাত খেয়েও তো বাঁচতে হবে।’