নিম্নমধ্যবিত্তের ভরসা সবজিও এখন ‘বিলাসী পণ্য’
বরিশাল শহরে ছোট একটি চাকরি করেন আল-আমিন। বেতনের বড় একটি অংশ চলে যায় বাড়িভাড়ায়। হাতে যা থাকে, তা দিয়ে টেনেটুনে চলে পুরো মাস। মাছ-মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন ভরসা ছিল সবজি-ডিমের ওপর। কিন্তু এখন যে অবস্থা সবজিও তাঁর কাছে বিলাসী পণ্য মনে হচ্ছে। কীভাবে পরিবার নিয়ে চলবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে নগরের চৌমাথা এলাকায় সবজি কেনার সময় হতাশার সুরে আল-আমিন বললেন, ‘চোখে অন্ধকার দেখছি। জীবনটাকে কীভাবে চালাব বুঝতে পারছি না। পরিবারে সব খাতে ব্যয় কমিয়েছি; তারপরেও টানাটানি। সবজি কিনব সেই অবস্থাও নেই। দাম শুনে মাথা ঘুরে যায়। এখন বাজারে আসার কথা শুনলেই মনটা বিষিয়ে ওঠে।’
দুদিন আগের ৮০ টাকার করলা-পটোল ১০০ টাকা, ১০ টাকা আঁটির কলমি শাক ২০, ৪০ টাকা কেজির পুঁইশাক ও পেঁপে ৫০, ১৩০ টাকার বরবটি ১৬০, ৫০ টাকার কচুমুখী ৬০, ৭০ টাকার বাঁধাকপি ৮০, ১৪০ টাকার পালংশাক ১৬০, ৭০ টাকার চিচিঙ্গা ৮০, ৮৫ টাকার কাঁকরোল ১০০, ৫০ টাকা কেজির মিষ্টিকুমড়া ৮০ টাকা হয়েছে।
আল-আমিনের মতো বাজার পরিস্থিতি নিয়ে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত ছয়জনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানালেন, বাজারে সব জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। মাঝারি মানের চালের কেজি ৭০ টাকা। ফার্মের ডিমের হালি ৪৩–৫০, চাষের পাঙাশ ২৪০–২৮০, রুই ৩৫০, কুচো চিংড়ি ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা। সব সবজির দাম আকাশছোঁয়া। কিন্তু আয় এক পয়সাও বাড়েনি। ধারদেনা কিংবা সঞ্চয় ভেঙেও নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো টানাপোড়েন ঘোচাতে পারছে না। এর মধ্যে ধাপে ধাপে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে চলায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
নগরের আলেকান্দা এলাকায় থাকেন ডিজেলচালিত তিন চাকার যানের চালক আনিসুর রহমান। মাসে সাকল্যে আয় ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। এর মধ্যে সাত হাজার টাকা বাড়ি ভাড়ায় চলে যায়। বাকি টাকা দিয়ে চারজনের সংসার টিমটিমিয়ে চলে। আনিসুর বললেন, ‘সবজি কিনছি তাতেই ৩৫০ নাই। এরপর অন্য বাজারসদাই। ক্যামনে আমাগো জীবন চলে একটু অঙ্ক মেলান!’
দাম তো আমরা বাড়াই না। বেশি দামে কিনি, বেচতেও হয় বেশি দামে। মোরা কী করমু?
নগরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাসখানেক ধরে সব নিত্যপণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়েই চলেছে। চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ ছাড়াও সবজি, মাছ, মাংস, মুরগিসহ সব জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। বিশেষ করে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সবজির বাজার সীমাহীন চড়েছে।
সবজির বাজার ঘুরে দেখা গেল, দুদিন আগের ৮০ টাকার করলা-পটোল ১০০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৪০০, ১০ টাকা আঁটির কলমি শাক ১৪ থেকে ২০, ৪০ টাকা কেজির পুঁইশাক ও পেঁপে ৫০, বড় বেগুন ২২০, ছোট লম্বা বেগুন ১২০ টাকা। দুই দিন আগেও তা ৯০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া ১৩০ টাকার বরবটি ১৬০, ৫০ টাকার কচুমুখী ৬০, ৭০ টাকার বাঁধাকপি ৮০, মাঝারি আকারের লাউ ৯০ থেকে ১২০, ১৪০ টাকার পালংশাক ১৬০, ৭০ টাকার চিচিঙ্গা ৮০, ৮৫ টাকার কাঁকরোল ১০০, ৫০ টাকা কেজির মিষ্টিকুমড়া ৮০ টাকা হয়েছে। ২৫০ গ্রামের লাল শাকের আঁটি ৩০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০ টাকা।
চাহিদা নিরূপণ করে সেই অনুযায়ী সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। চাপ প্রয়োগ করে নয়; ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বাজার সহনীয় রাখতে হবে। একই সঙ্গে কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নজরদারি প্রয়োজন।রণজিৎ দত্ত, সাধারণ সম্পাদক, ক্যাব, বরিশাল
বাজারের ব্যবসায়ীরা জানালেন, সবজির দাম চড়া হওয়ায় এখন ক্রেতারা কিনছেনও কম। আগে যিনি এক কেজি কিনতেন, এখন তিনি ২৫০ গ্রাম কিংবা আধা কেজি কিনছেন। অনেকেই আবার দাম শুনে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছেন।
সবজি ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বললেন, ‘আগের চাইতে বেচাবিক্রি অনেক কমে গেছে। দাম বেশি অওনে মানুষ অল্প অল্প কেনে। বাজারে সবজির সরবরাহ কম, তাই দামও বেশি। তবে এবার সবজির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। হয়তো বন্যার কারণে এই অবস্থা হয়েছে।’
চৌমাথা এলাকার সবজি বিক্রেতা লিটন হাওলাদার বললেন, ‘দাম তো আমরা বাড়াই না। বেশি দামে কিনি, বেচতেও হয় বেশি দামে। মোরা কী করমু?’
ব্যবসায়ী রবিউল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাইকারি হাটে গেলে মাথা ঘোরে দাম শুইন্না। পাইকারেরা কথা কয় পাক্কা মাইর্যা। কয়, “ভালো লাগলে নেন, না লাগলে পথ দ্যাহেন।”’ দাম বেশি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোকামে সবজি কেনতে গ্যালে আমরাও হেই প্রশ্ন পাইকারি ব্যবসায়ীগো ধারে করি। হ্যারা কয়, মোকামে মালের সংকট, হেইতে দাম বেশি।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বরিশাল জেলার সাধারণ সম্পাদক রণজিৎ দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যবিত্তের মাছ-মাংস কেনার সাধ্য ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে। শাকসবজি কেনার সাধ্য থাকলেও অস্বাভাবিক দামের কারণে এখন সেগুলোর ধারেকাছে ভেড়া কঠিন। নিত্যপণ্যের দাম অস্থিতিশীল হওয়ায় মানুষ ভীষণ কষ্টে আছেন। এটা কেউ বুঝতে চান না। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারকে বাজারের সরবরাহব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। চাহিদা নিরূপণ করে সেই অনুযায়ী সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। চাপ প্রয়োগ করে নয়; ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বাজার সহনীয় রাখতে হবে। একই সঙ্গে কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নজরদারি প্রয়োজন।