বাহারি নামের ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে মানুষের ভিড়

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর ইউনিয়নে ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা। বাহারি নামের ঘোড়া এখানে অংশ নেয়। আজ বুধবার বিকেলেছবি: প্রথম আলো

ফসল উঠে গেছে কৃষকের ঘরে। আমন ধানের মাঠ এখন ফাঁকা। সেই মাঠে বাঁশের সঙ্গে দড়ি বেঁধে তৈরি করা হয়েছে বৃত্তাকার পথ। দুই পাশে হাজারো মানুষ। কেউ বসা, আবার কেউবা দাঁড়িয়ে। মাঝখানে প্রাণপণ ছুটছে প্রতিযোগী ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে সওয়ারি। গতি বাড়াতে ঘোড়ার পিঠে পড়ছে চাবুকের ঘা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক ঘোড়া থেকে অন্য ঘোড়ার বাড়ে ব্যবধান। একসময় সব ঘোড়াকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় একটি ঘোড়া। মাঠভরা দর্শক সেই ঘোড়া ঘিরে মেতে ওঠে জয়োল্লাসে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর ইউনিয়নে আজ বুধবার হয়ে গেল ঐতিহ্যের এমন এক ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। বিলপাড়ার আমন ধান কাটার পর ফাঁকা মাঠে এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল ‘সালন্দর চাষি ক্লাব’। প্রতিযোগিতা দেখতে মানুষের ঢল নেমেছিল।

পৌষের বিকেলে হিমেল বাতাসের মধ্যেও মাঠে ভিড় করতে শুরু করে শিশুসহ নানা বয়সী মানুষ। একে একে মালিক ও ঘোড়সওয়ার ঘোড়াগুলো নিয়ে মাঠে নামতে শুরু করলেন। সাদা, কালো, লাল—হরেক রঙের ঘোড়া। ঘোড়াগুলোর নামও বাহারি। এসব ঘোড়াকে কেউ ঘোড়া বলে ডাকে না। স্বভাব আর চরিত্রভেদে নাম থাকে নানা রকম। কোনোটির নাম ‘রেড হর্স’। আবার কোনটি ‘তুফান’। এ ছাড়া আছে ‘বাংলার বাঘ’, ‘পঙ্খীরাজ’, ‘সোনিয়া রানী’, ‘ময়না’, ‘রাজাবাবু’, ‘বুলেট’, ‘পুষ্পা’সহ অনেক নামের ঘোড়া। আর তা ঘিরে দর্শকদের উৎসাহ বাড়তে থাকে। হাততালি দিয়ে তারা স্বাগত জানায়। কেউ কেউ ঘোড়ার সঙ্গে ছবি তোলেন।

ঘোড়ার এমন নামকরণ প্রসঙ্গে আবুল হোসেন মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক খোদা বখশ বলেন, এসব ঘোড়ার নামকরণ আসলে সময়ভেদে বদলায়। আগে জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা বা সাহসী কোনো চরিত্রের নামে নামকরণ করা হতো বেশি। এখন চলচ্চিত্রের নাম ঘোড়দৌড়ে প্রবেশ করেছে।

নীলফামারীর ডোমার থেকে ঘোড়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় এসেছেন আবদুল হাদী। তাঁর ঘোড়ার নাম পঙ্খীরাজ। তিনি বললেন, যেখানে দাওয়াত পান, সেখানেই ঘোড়া নিয়ে দৌড়ে অংশ নেন। ঘোড়দৌড়ে অংশ নেওয়া নেশা হয়ে গেছে।

আয়োজকেরা জানান, চূড়ান্ত পর্যায়ের ঘোড়দৌড়ে প্রথম হয় দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের আশরাফুল আলমের ঘোড়া রেড হর্স। দ্বিতীয় হয় নীলফামারীর কাফি বানিয়ার ঘোড়া। তৃতীয় হয় মো. জাকারিয়ার ঘোড়া সোনিয়া রানী। অংশগ্রহণকারী সব ঘোড়ার জন্য পুরস্কার থাকলেও বিজয়ী ঘোড়ার মালিকদের ডিনারসেট, রাইস কুকার, মুঠোফোন উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।

বিজয়ী ঘোড়ার মালিকদের ডিনারসেট, রাইস কুকার, মুঠোফোন উপহার হিসেবে দেওয়া হয়
ছবি: প্রথম আলো

আশরাফুলের ঘোড়া রেড হর্সের সওয়ার ছিল বগুড়ার ছেলে মো. মারুফ। দৌড়ে তাঁর ঘোড়া প্রথম হওয়ায় খুশি তিনি। আশরাফুল প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘোড়দৌড়ে অংশগ্রহণ করছেন। তাঁরা শুধু প্রতিযোগিতার জন্যই ঘোড়া পোষেন। ঘোড়া নিয়ে যেখানেই খেলা হয়, সেখানেই ছুটে যান।

দাদা মো. শাহবুদ্দীন হাত ধরে ঘোড়দৌড় দেখতে এসেছিল শারমিন আক্তার। শারমিন বলে, ‘ঘোড়াগুলো কত বড়। কত জোরে দৌড়ায়। এখানে এসে আমি খুব খুশি।’

শাহাবুদ্দীন বলেন, যখন ছোট ছিলাম, তখন প্রতিবছরই বিভিন্ন এলাকায় এই সময় ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা হতো। এখন এই খেলা খুব একটা দেখা যায় না। আজকে সুযোগ পেয়ে ঘোড়দৌড় দেখতে নাতিকে নিয়ে এসেছি। অনেক মানুষ হয়েছে, খুবই ভালো লাগছে।’

সালন্দর চাষি ক্লাবের উপদেষ্টা ও ঠাকুরগাঁওয়ের সালন্দর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলে এলাহী বলেন, ‘গ্রামের মানুষকে একটু বিনোদন দিতেই ঐতিহ্যবাহী এই ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করা হয়েছে। এ আয়োজন ঘিরে মানুষের উৎসাহ দেখে আমি অনুপ্রাণিত। আরও বড় পরিসরে গ্রামীণ খেলা নিয়ে আয়োজন করার কথা ভাবছি।’