‘ছেলেডার কত্ত করে মানা কল্লাম, বুজালাম। বুললাম, আর ইন্ডিয়ায় যাইসনে বাপ। কষ্ট হলিও মাটে খাইটেই খা। তোর আর পাকির (পাখি) ব্যবসা করতি হবিনে, সে আমার কতা শুনল না। ইবার ইন্ডিয়া যাওয়ার সুমায় সে বুলল, “কতা দিচ্চি, এবেড্ডা ঘুরে আইসে আর যাব না মা।” সেই যাওয়াই যে শেষ যাওয়া, বুজতি পারিনি বাপু।’
গতকাল রোববার বিকেলে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের পীরপুরকুল্লা গ্রামের যুগীরপাড়ায় নিজ বাড়িতে বিলাপ করছিলেন আর এসব কথা বলছিলেন বিএসএফের গুলিতে নিহত রবিউল হকের সত্তরোর্ধ্ব বয়সী মা আনজিরা খাতুন।
আনজিরা খাতুনের সাত মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন রবিউল হক। গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের ঠাকুরপুর সীমান্তের বিপরীতে ভারতীয় অংশে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন রবিউল হক। পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী ছিলেন তিনি। প্রায় দেড় মাস পর ১১ নভেম্বর বিকেলে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে রবিউলের পচা-গলা লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
গতকাল নিহত রবিউলের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মা আনজিরা খাতুনকে বিলাপ করতে দেখা যায়। এ সময় আনজিরা বলেন, ‘পাকির (পাখির) ব্যবসা করতি গিয়ে আমার জানপাকিডাই আজ খাঁচাছাড়া হয়ে গ্যালো। দেড় মাস ধরে কানতি কানতি চোকি আর পানি নেই। কষ্টে বুকডা ফাইটে যাচ্চে।’
দুই সন্তান রাকিব আলী (২০) ও রকি আলীকে (১৬) রেখে রবিউল হকের প্রথম স্ত্রী ১৩ বছর আগে মারা যান। এরপর কুড়ালগাছি গ্রামের আসমা খাতুনকে বিয়ে করেন রবিউল। আসমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। আসমা খাতুন বলেন, রবিউল পাঁচ মাস ইটভাটায় এবং বাকি সময় মাঠে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। বেশ কয়েক মাস ধরে নতুন গ্রামের বায়েজিদের সঙ্গে সন্ধ্যা সাতটার দিকে ছোট ছোট পাখির চালান নিয়ে ভারতে যেতেন। রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যেই ফিরে আসতেন। এ জন্য ৫০০ টাকা করে মজুরি পেতেন। মহাজনরা পাখির চালান দিয়ে চলে যেতেন। তবে তিনি মহাজনদের চিনতেন না।
নিহত রবিউলের বড় ছেলে রাকিব আলী বলেন, অভাবের সংসারে ষষ্ঠ শ্রেণিতেই তাঁর পড়াশোনা থেমে যায়। তবে বাকি দুই ভাই পড়াশোনা করে। রকি আলী ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছোট ভাই ও একমাত্র বোন রুমানা স্থানীয় মসজিদের হুজুরের কাছে আরবি পড়ে, স্কুলে ভর্তি করা হয়নি।
রাকিব আরও বলেন, ‘আব্বা মারা যাওয়ার পর থিকা ডেইলি বর্ডারে গিয়ে বইসে থাকি। এই বুজি লাশ ফেরত দেবে। প্রায় দেড় মাস পর শনিবার বিকেলে আব্বার লাশ যকন হাতে পালাম, তকন তার চিনার উপায় ছিল না। অযত্ন–অবহেলায় লাশ পচে–গলে দুর্গন্ধ বের হয়েছে, কাছে যাওয়া যায়নি। গরিপ হলিও আব্বা খুপ শৌখিন মানুষ ছিল। তার শেষ পরিণতি এরাম হবে, কল্পনাও করতি পারিনি।’