নদী-খাল দখল ও ভরাটের কারণে বন্যার পানি নামছে ধীরগতিতে

কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার ঝলম দক্ষিণ এলাকার বর্তমান পরিস্থিতি। বন্যার পানি ধীরগতিতে নামায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ছবিটি গতকাল তোলাছবি: প্রথম আলো

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় কুমিল্লার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টিই আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে বন্যাকবলিত এলাকা থেকে নামতে শুরু করেছে পানি। তবে অন্য উপজেলাগুলোর তুলনায় মনোহরগঞ্জ, লাকসাম ও নাঙ্গলকোটে বানের পানি কম হারে নামছে। এসব এলাকায় এখনো পানিবন্দী লক্ষাধিক মানুষ। আর মনোহরগঞ্জের বেশির ভাগ রাস্তাঘাট ডুবে আছে। ফলে জেলার দক্ষিণাঞ্চলের এই তিন উপজেলায় দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

সরেজমিন ওই তিন উপজেলার বানভাসি মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত সময়ে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ও প্রভাবশালীরা বিভিন্নভাবে অঞ্চলগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ডাকাতিয়া নদী ও এর শাখা খালগুলো দখল করেছেন। এ ছাড়া ছোট-বড় খালগুলোও স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল ও ভরাট করেছেন। অনেক স্থানে খালের মধ্যে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছে রাস্তা। এসব কারণে এই তিন উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা কমেনি।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অঞ্চলগুলোর বাসিন্দারা। তাঁদেরই একজন নাঙ্গলকোট উপজেলার রায়কোট উত্তর ইউনিয়নের পিপড্ডা গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আরিফুর রহমান মজুমদার। তিনি বলেন, ‘এই জীবনে কহনো এত বড় বান (বন্যা) আর এত পানি দেহি নাই। আমার বাপের কাছেও শুনি নাই!’

২০ থেকে ২২ দিন ধরে আরিফুর রহমানের এলাকার অনেক বাড়িঘরের বিভিন্ন অংশ পানির নিচে তলিয়ে আছে। চারদিকে তাকালে দেখা যায় মানুষের দুর্ভোগ, হাহাকার আর কষ্টের চিত্র। ১০ থেকে ১২ দিন ধরে পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে যেভাবে পানি কমছে, তাতে এই দুর্ভোগ সহজে শেষ হবে না বলে মনে করেন এই বৃদ্ধ।

সার্বিকভাবে কুমিল্লার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। অনেক স্থান দখল ও ভরাটের কারণে পানি নামার পথ সংকুচিত হয়ে গেছে। অবাধে নদী ও খাল দখল এবং ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নামতে সমস্যা হচ্ছে। জেলার দক্ষিণাঞ্চলের পানি ডাকাতিয়া নদীর মাধ্যমে নাঙ্গলকোট, লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, চাঁদপুরের শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জ হয়ে চাঁদপুরে গিয়ে মেঘনা নদীতে মেশে। ধীরগতির কারণে এসব এলাকায় পানি নামতে সময় লাগছে।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান

কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, সার্বিকভাবে কুমিল্লার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। অনেক স্থান দখল ও ভরাটের কারণে পানি নামার পথ সংকুচিত হয়ে গেছে। অবাধে নদী ও খাল দখল এবং ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নামতে সমস্যা হচ্ছে। জেলার দক্ষিণাঞ্চলের পানি ডাকাতিয়া নদীর মাধ্যমে নাঙ্গলকোট, লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, চাঁদপুরের শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জ হয়ে চাঁদপুরে গিয়ে মেঘনা নদীতে মেশে। ধীরগতির কারণে এসব এলাকায় পানি নামতে সময় লাগছে।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রভাবশালীরাই নন, বিগত সময়ে খাল ভরাট করে এসব অঞ্চলের মানুষ ও কৃষির ব্যাপক ক্ষতি করে কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানও। ২০২০ সালের শুরু থেকে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক চার লেন প্রকল্পে কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে ভরাট হয় শত বছরের বেরুলা খালটি। এটির দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৬০ কিলোমিটার। লাকসাম, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ হয়ে খালটি মিশেছে নোয়াখালীর চৌমুহনী খালে গিয়ে। এরপর সেখান থেকে এই পানি যেত বঙ্গোপসাগরে। কিন্তু খালটি ভরাটের কারণে এ অঞ্চল থেকে পানি নামতে তীব্র সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, কয়েক হাজার একর কৃষিজমি ও কৃষকেরও সর্বনাশ হয়েছে।

আরও পড়ুন

ডাকাতিয়া নদীর প্রস্থ গড়ে ২২০ ফুট হওয়ার কথা বলে উল্লেখ করেন লাকসাম পৌর এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম। তিনি বলেন, লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজার এলাকায় নদীটির অস্তিত্ব ৪০ ফুটও নেই। সব দখল করে দোকানপাট নির্মাণ করা হয়েছে। বিগত সময়ে জলাধার দখলকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের তেমন কোনো অভিযান দেখা যায়নি। এসব কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

মনোহরগঞ্জ উপজেলা সদরের বাসিন্দা হারুনুর রশিদের মতে, অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে বন্যার পানি নামায় এই ধীরগতি। তিনি বলেন, মনোহরগঞ্জ-হাসনাবাদ সড়কের লৎসর, শাকতলাসহ কয়েকটি স্থানে আগে কালভার্ট ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরে সড়ক সংস্কারের সময় কালভার্টগুলো ভেঙে খাল ভরাটের পর রাস্তা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এসব কারণে কয়েকটি ইউনিয়নের পানি নামতে সমস্যা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

মনোহরগঞ্জ উপজেলাকে অনেক আগে থেকেই জলাঞ্চল বলা হতো বলে জানান উপজেলার মান্দারগাঁও এলাকার বাসিন্দা ফিরোজ আলম। তিনি বলেন, এবারের বন্যা অতীতের সব বন্যাকে হার মানিয়েছে। মানুষের দুঃখ ও দুর্ভোগ চরম আকারে পৌঁছেছে।

মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজালা রানী চাকমা বলেন, ‘নদী-খাল দখল ও বাঁধ দিয়ে মাছ শিকারের কারণে পানি নামতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে, এটা সত্য কথা। তবে আমরা প্রতিটি খাল ও নদীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অব্যাহত রেখেছি। এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক বাঁধ অপসারণ করে পানির প্রভাব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি নেই, পরিস্থিতি এমন থাকলে দ্রুতই বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করছি।’

নাঙ্গলকোটের ইউএনও সুরাইয়া আক্তার মতে, এ উপজেলায় বর্তমানে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। নদী ও খালের যেসব স্থানে বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে, সেসব স্থানে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।