শর্ত দিয়ে মুরগির ছানা বিক্রি ও সিন্ডিকেটকে দুষলেন শ্রীপুরের খামারিরা

ডিম উৎপাদনে বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়া ও সিন্ডিকেটের কারণে বাজার অস্থিতিশীল বলে মনে করেন খামারিরা। মঙ্গলবার বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুরে লোহাগাছ গ্রামের একটি খামারেছবি: প্রথম আলো

খোলাবাজারে মুরগির ডিমের দাম বাড়ার পেছনে ডিম উৎপাদনকারীদের কোনো ভূমিকা নেই বলে দাবি করেছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার খামারিরা। তাঁরা বলছেন, খামারিদের কাছে শর্ত দিয়ে মুরগির ছানা বিক্রি করছেন বড় ব্যবসায়ীরা। পরে তাঁদের কাছ থেকেই মুরগির খাবার কিনতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। উৎপাদনের পর কয়েক হাত ঘুরে ভোক্তার হাতে ডিম পৌঁছানোয় বাড়ছে ডিমের দাম।

গতকাল মঙ্গলবার ডিম উৎপাদনে প্রথম সারিতে থাকা শ্রীপুর উপজেলার কয়েকটি পোলট্রি খামার ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে। খামারিরা বলছেন, ডিমের দাম কমানোর জন্য প্রথমে উৎপাদন ব্যয় কমাতে হবে। এ জন্য উপকরণের দাম কমাতে হবে। পাশাপাশি খামার থেকে সরাসরি ভোক্তার কাছে ডিম পৌঁছানো গেলে দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শ্রীপুরে শুধু ডিম উৎপাদনকারী খামারের সংখ্যা ৫৮০। এসব খামারে দৈনিক ৭ লাখ ৬৭ হাজার ডিম উৎপাদিত হচ্ছে। এসব ডিমের মধ্যে ৫ লাখ ২০ হাজার উপজেলার বাইরে সরবরাহ করা হয়। বাকি ডিম স্থানীয় বাজারে ভোক্তারা কেনেন।

খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মঙ্গলবারের জন্য খামারে লাল ডিমের পাইকারি মূল্য নির্ধারণ করা ছিল প্রতিটি ১২ টাকা ৬০ পয়সা। আর সাদা ডিম ছিল ১১ টাকা ৮০ পয়সা করে। ঢাকার পাইকারি আড়ত থেকে এই দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। উপজেলার কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন দোকানে খুচরা পর্যায়ে ১৪ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১৫ টাকা করে প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে। খামারিরা জানিয়েছেন, বর্তমানে তাঁদের প্রতিটি ডিম উৎপাদন করতে গড়ে ১০ টাকা খরচ হয়।

আরও পড়ুন

শ্রীপুরের লোহাগাছ গ্রামের রাফিন পোলট্রি ফার্মের স্বত্বাধিকারী মো. মুস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিমের দাম ও উৎপাদন সিন্ডিকেটে আটকে আছে। সরাসরি ভোক্তার কাছে ডিম বিক্রি করতে দেন, সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে। সেটি স্থানীয় পর্যায়েই হোক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ মহানগরীতেই হোক।’ তিনি আরও বলেন, আড়তদার মাত্র ১৫ থেকে ২০ পয়সা ব্যবসা করেন; কিন্তু খামারি ও আড়তদারের মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগীরা অনেক বেশি লাভ করেন।

পোলট্রি খাদ্য, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন উপকরণ ও পরিবহন ব্যয় বেড়েছে বলেন জানান উপজেলার গোলাঘাট গ্রামের তানিশা পোলট্রি ফার্মের স্বত্বাধিকারী আবু তালেব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ব্যয় বাড়লে ডিমের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তবে ভোক্তা পর্যায়ে বর্তমানে এত বেশি দামে ডিম বিক্রির পক্ষে তাঁরা নন। তাঁর পরামর্শ, খাদ্য আমদানি, ওষুধ, বিদ্যুৎ বিল, পোলট্রি শেডের জন্য লোহার খাঁচা তৈরির খরচ, কর্মচারী ব্যয়সহ আনুষঙ্গিক খরচ কমানোর জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

আরও পড়ুন

খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিম উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকে থাকেন খামারিরা। প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছে শর্ত ছাড়া বাচ্চা বিক্রি করে না। মুরগির বাচ্চা নিতে হলে এসব কোম্পানি তাদের কাছ থেকে খাদ্য কেনার শর্ত জুড়ে দেয়। এরপর তাদের ইচ্ছেমতো খাদ্যের দাম বাড়িয়ে খামারিদের কাছে বিক্রি করেন। এভাবে খামারিরা করপোরেট ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকেন। এ ছাড়া রাজধানীসহ বিভিন্ন পাইকারি আড়তে ডিম পৌঁছার আগেই তিন থেকে চারটি হাতবদল হয়। এসব হাতবদলের সময় দাম বাড়ানো হয়। তাঁদের মতে, পাইকারি আড়তে অভিযান চালিয়ে ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য।

ডিম উৎপাদনে বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়া ও সিন্ডিকেটের কারণে বাজার অস্থিতিশীল বলে মনে করেন খামারিরা। মঙ্গলবার বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুরে লোহাগাছ গ্রামের একটি খামারে
ছবি: প্রথম আলো

উৎপাদন খরচের পরে একটি ডিমে ৩০ থেকে ৪০ পয়সা লাভ করতে পারলেই খুশি উপজেলার বালিয়াপাড়া গ্রামের নাজিম পোলট্রি ফার্মের স্বত্বাধিকারী মো. নাজিম উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাচ্চা বড় করার জন্য ধানের তুষ এক বছর আগে ছিল ছয় টাকা কেজি। এখন বেড়ে হয়েছে ১৫ টাকা। আট হাজার টাকা হলে কর্মচারী পাওয়া যেত। এখন মাসে ২০ হাজার টাকা গুনতে হয়। আবার বছরের বেশির ভাগ সময় লস দিয়ে ডিম বিক্রি করতে হয়। এই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে এই খাতকে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে।’

আরও পড়ুন

শ্রীপুর বাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, বেশি দামে ডিম কিনতে হচ্ছে। মাত্র কয়েক পয়সা লাভে ক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন। দাম বেশি হলেও ক্রেতারা ডিম কিনছেন। আরেক মুদিদোকানি রফিকুল ইসলাম বলেন, ডিম আর সাধারণ মানুষের খাদ্য নেই। এর দাম কমানোর উদ্যোগ না নিলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চলবে?

শ্রীপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আশরাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার কারণে বিভিন্ন এলাকায় পোলট্রি ফার্মের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া অতি বৃষ্টির কারণে প্রতি বছরই এ সময়ে শাকসবজির উৎপাদন কম হয়ে থাকে। এসব কারণে দাম বেড়ে যায়। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে দাম সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।