পাঁচগাঁওয়ে ৩০০ বছরের ঐতিহ্য ‘লাল দুর্গা’ দর্শনে ভক্তদের ভিড়

লাল দুর্গার দর্শন পেতে ভক্তদের ভিড়। বৃহস্পতিবার সকালে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়েছবি: প্রথম আলো

আশ্বিনের আলোর সকাল। সবুজ মাঠ, গ্রামপ্রকৃতি। আকাশে ভাসমান টুকরো টুকরো মেঘদল। এই বুঝি বৃষ্টি নামে, এমন মেঘ-ছায়া ও রোদের খেলা। এর মধ্যে ঘুমভাঙা চোখ নিয়ে অনেকেই ছুটে এসেছেন ‘লাল দুর্গা’র মণ্ডপে। ভিড় কম হবে, মনে করেই সাতসকালে ভক্তদের ছুটে আসা। তাতেও ভিড়ের খুব একটা কমতি নেই। আলো বাড়ছে, সঙ্গে ভক্তদের ভিড়ও।

মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে এই ‘লাল দুর্গা’ তিন শতাধিক বছর ধরে সনাতন ধর্মের লোকদের কাছে আলাদা গুরুত্ব পেয়ে আসছে। এখানে প্রতিমার রং লাল। ভক্তদের বিশ্বাস, এই দুর্গাবাড়িতে স্বয়ং দেবী অধিষ্ঠান করেন। এই প্রতিমা হচ্ছেন জাগ্রত। এই বিশ্বাসে শারদীয় দুর্গাপূজায় ভক্তদের এখানে ছুটে আসাও বেশি। প্রতিবছর শারদীয় দুর্গাপূজায় এই প্রাঙ্গণটি উৎসব ও মেলায় সেজে ওঠে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজনগরের পাঁচগাঁওয়ে গিয়ে দেখা গেছে, সকালবেলাতেই নিরিবিলি গ্রামটি নানা বয়সের মানুষের পদচারণে মুখর হয়ে উঠেছে। রাজনগর উপজেলা সদর থেকে রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়ক ধরে যাওয়ার পথে পূজাকেন্দ্রের এক কিলোমিটার দূরেই উৎসবের মেজাজ ধরা পড়ে। পথের পাশে বসেছে মোমবাতি, আগরবাতিসহ বিভিন্ন পণ্যের ভ্রাম্যমাণ দোকান। পথের দুই পাশে দাঁড় করানো কার, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন রকমের যানবাহনের ভিড়। দিনের বেলা ভিড়ের চাপ এড়াতেই এই সকালে দূরদূরান্ত থেকে অনেকে সপরিবার গাড়ি ভাড়া করে এখানে ছুটে এসেছেন।

দুর্গাবাড়ি প্রবেশপথের দুই পাশে বসেছে অনেক দোকান। এর কিছুটা স্থায়ী, অনেকটাই উৎসবকেন্দ্রিক। আছে তিলুয়া-বাতাসা, খাজা, গজা, জিলাপি, মিষ্টি, ফুচকাসহ বিভিন্ন রকমের খাবারের দোকান। আছে শিশুর খেলনাসামগ্রী, ঘরগৃহস্থ ও পূজার নানা উপকরণ। লোকজন পথ চলতে দেখছেন, কিনছেন। পূজাকেন্দ্রে ঢোল-কাঁসর বাজছে। দুর্গাবাড়ির প্রতিমার সামনে জ্বালানো হচ্ছে মোমবাতি, আগরবাতি। ভক্তরা নানা মানসে এই বাতিগুলো প্রজ্বালন করছেন।

পাঁচগাঁওয়ের দুর্গামন্দির। বৃহস্পতিবার সকালে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে
ছবি: প্রথম আলো

পাঁচগাঁওয়ের এই প্রতিমা নিয়ে ভক্তদের আগ্রহ, কৌতূহলের পেছনে রয়েছে প্রায় ৩০০ বছর আগের ইতিহাস। কথিত আছে, সর্বানন্দ দাস নামে একজন সাধক পুরুষ বর্তমান ভারতের আসাম রাজ্যের শিবসাগরে মুনশি পদে চাকরি করতেন। সাধক পুরুষটি একবার আসাম রাজ্যের কামাখ্যা বাড়িতে গিয়ে পূজার জন্য স্থানীয় লোকদের কাছে পাঁচ বছর বয়সের একটি মেয়েকে চাইলেন। লোকজন তাঁকে পাঁচ বছরের একটি মেয়ে জোগাড় করে দিলেন। সর্বানন্দ দাস সেই ছোট মেয়েটিকে পূজা দিতে শুরু করেন। পূজা চলার একপর্যায়ে ধীরে ধীরে মেয়েটির শরীরের রং বদলে যায়, শরীরের ত্বক লাল রং ধারণ করে। বিস্মিত, হতবাক সর্বানন্দ দাস বুঝতে পারেন মেয়েটির মধ্যে তখন স্বয়ং দেবী ভর করেছেন।

মেয়েটি একপর্যায়ে সর্বানন্দ দাসকে বলে, ‘তুমি আমার কাছে বর (আশীর্বাদ) চাও। আমি তোমাকে বর দেব।’ তিনি তখন মেয়েটির কাছে ব্যক্তিগত সম্পদ-প্রাচুর্য এ রকম কিছু চাননি। মেয়েটির কাছে চাইলেন, প্রতিবছর শারদীয় দুর্গাপূজার সময় পাঁচগাঁও দুর্গামণ্ডপে স্বয়ং দেবীকে আসতে হবে। ওই পাঁচগাঁও তাঁর জন্মস্থান। মেয়েরূপী দেবী তখন নির্দেশ দিলেন, পাঁচগাঁওয়ের প্রতিমার রং হবে লাল। সেই থেকে পাঁচগাঁওয়ে লাল বর্ণের প্রতিমার পূজা হয়ে আসছে।

ভক্তরা নানা মানসে মোমবাতি প্রজ্বালন করছেন
ছবি: প্রথম আলো

পূজার আয়োজকেরা জানিয়েছেন, দেশে পাঁচগাঁওয়ের দুর্গাবাড়িতেই দেবী দুর্গার রং লাল, আর কোথাও লাল বর্ণের দেবী নেই। তবে ভারতের আসাম ও কামাখ্যায় লাল বর্ণের প্রতিমা আছে। পাঁচগাঁওয়ে ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে ভক্তদের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছেন এই লাল বর্ণের দেবী। পূজার এই সময়টি হাজারো হিন্দুধর্মাবলম্বী তাঁদের নানা মানত নিয়ে এখানে ভিড় করেন। কেউ হোমযজ্ঞ দেন, কেউ মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালান। পূজার সপ্তমী ও নবমীতে পাঁঠা, মহিষ, হাঁস ও কবুতর দেবীর নামে এখানে বলি দেন অনেকে। এখানকার দেবী জাগ্রত হওয়ায় সারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে দেবী-দর্শনে সপরিবার দল বেঁধে ছুটে আসেন অনেকেই। অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারের কাছে শারদীয় দুর্গাপূজায় পাঁচগাঁওয়ের দেবী-দর্শন অনেকটাই নিয়মিত। অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষও এই উৎসবস্থলে ছুটে আসেন, ঘুরে বেড়ান। মেলায় কেনাকাটা করেন।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, পূজাকে কেন্দ্র করে এই চার-পাঁচ দিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দেবী-দর্শনকারী ভক্ত ও সাধারণ দর্শনার্থীর ভিড়ে এলাকাটি সরগরম থাকে। রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়কে ছোট-বড় গাড়ির দীর্ঘ জট তৈরি হয়ে যায়। বেশি ভিড় হয় সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর দিনে।

পূজা উপলক্ষে বসেছে বিভিন্ন ধরনের দোকান
ছবি: প্রথম আলো

সর্বানন্দ দাসের এক উত্তরপুরুষ পাঁচগাঁও দুর্গাপূজার পরিচালক সঞ্জয় দাস প্রথম আলোকে বলেন, তিনি হচ্ছেন পূজা পরিচালনাকারীদের ষষ্ঠ পুরুষ। বংশানুক্রমিকভাবে তাঁরা এই পূজা পরিচালনা করে আসছেন। ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁদের বাড়িতে এই ব্যতিক্রমী লাল বর্ণের দেবী দুর্গার পূজা হচ্ছে। তবে ১৯৭১ সালে এই পূজায় ছেদ পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করা সম্ভব হয়নি। সেবার ঘটে পূজা করা হয়েছিল। এটি মূলত তাঁদের পারিবারিক পূজা। দেবীর জাগ্রত উপস্থিতির কারণে প্রতিমা দর্শনে এখানে লোকের ভিড় হয়ে থাকে। এ জন্য পূজার এই কয়েক দিন তাঁদের হিমশিম খেতে হয়।

সঞ্জয় দাস বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পূজা ঠিকঠাক শুরু হয়েছে। প্রশাসন থেকে সব সহযোগিতা আছে। তবে এবার এখনো (গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল) অন্য বছরের তুলনায় ভিড় কিছুটা কম মনে হচ্ছে।’