গোমতীর চরে হাত দিতেই বেরিয়ে আসছে আলু

কুমিল্লার গোমতী নদীর চরে বুড়িচং উপজেলার ভান্তির চরে এবার আলুর ভালো ফলন হয়েছে। সোমবার দুপুরেছবি: এম সাদেক

গোমতী নদীর ভান্তির চর। বেড়িবাঁধ সড়ক হয়ে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার এই চরে যেতেই চোখে পড়ল একদল নারীর ব্যস্ততা। তাঁরা ফসলের জমি থেকে আলু তুলছেন। নারীরা নরম মাটিতে আলতো করে হাত দিতেই বেরিয়ে আসছে সাদা রঙের আলু। ওই চরজুড়ে এখন আলুর হাসি। ভালো ফলনের কারণে সেই হাসির ঝিলিক লেগেছে কৃষকের মুখেও।

 কুমিল্লার কৃষি বিভাগ ও চরের কৃষকেরা বলছেন, এ বছরের আগস্টে হওয়া ভয়াবহ বন্যায় গোমতী নদীর চরে কৃষিজমিতে পলি জমেছে। ফলে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে।

 সোমবার দুপুরে সরেজমিনে ভান্তির চরে দেখা যায়, দলে দলে বিভক্ত হয়ে খেত থেকে আলু তুলছেন নারীরা। কিছু জমিতে কয়েকজন পুরুষ ব্যস্ত সময় পার করছেন নতুন আলু তোলার কাজে। আলুর সঙ্গে একই জমিতে চাষ করা হয়েছে মিষ্টিকুমড়ার। তবে যাঁরা আলু তুলছেন, তাঁদের কেউই মিষ্টিকুমড়ার গাছ নষ্ট করছেন না। নারী ও পুরুষেরা আলু তোলার পর পুরুষদের আরেকটি দল এসব আলু টুকরিতে করে নিয়ে বস্তায় ভরছে। এরপর সুতলি দিয়ে বস্তার মুখ সেলাই করা হচ্ছে। সব শেষে পুরুষদের আরেকটি দল কাঁধে ভারে করে এসব আলুর বস্তা নিয়ে যাচ্ছে গোমতীর বেড়িবাঁধ সড়কে। সেখান থেকে বিক্রির জন্য এসব আলু চলে যাবে বিভিন্ন পাইকারি বাজারে।

 ভান্তির চরের মতো একই দৃশ্য দেখা গেছে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার গোমতী নদীর আমতলী চরেও। এই চরে আশপাশের এলাকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলুর আবাদ করা হয়েছে। বুড়িচং উপজেলায় কিং বাজেহুরা চরসহ পুরো নদীর চরের মধ্যেই অন্যান্য শাকসবজির পাশাপাশি আলুর আবাদ করতে দেখা গেছে কৃষকদের।

 ভান্তির চরে আলু তোলার কাজে ব্যস্ত থাকা আবেদা খাতুন নামের স্থানীয় এক নারী বলেন, ‘আমরা একলগে ১২ জন কাম করতাছি। দুপুরে আমরারে খাওন দিবো। বিকালে যাওনের সময় ৫০০ কইরা টাকা দিবো। এই সিজনে আলুর কাম বেশি থ্যাহে। আমরার ভালাই ইনকাম হয়। আলু তোলার সময় কুমড়ার গাছডি নষ্ট করি না। কয়দিন পর এই গাছডি থ্যাইক্কা কুমড়া বেচবো খেতের মালিকে।’

 আলু তোলার কাজে কৃষিশ্রমিকদের নেতৃত্বে থাকা উপজেলার মিরপুর গ্রামের শাহজাহান বলেন, ‘আমরা অহন চুক্তিতে কাম করি। প্রতি কানির (৪০ শতাংশ) আলু তুলি ৮ হাজার টাকা কইরা। আজকা ২০ জন কাজ করতাছি, যার মইধ্যে ১২ জন মহিলা। আশা করতাছি আজকা আড়াই কানি জমির আলু তুলতাম পাইরাম। আমরা আলু তুইল্যা বস্তায় ভইরা রাস্তায় নিয়া দিয়া আহি। পরে মালিকে আড়তে নিয়ে বেচে।’ তিনি বলেন, তিনি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এভাবে চুক্তিতে আলু তুলছেন। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আলুর আকার কিছুটা বড় এবং দেখতেও ভালো।

 এ ভান্তির চরে গিয়ে জানা গেছে, আলু তোলার সময় হলে অনেক কৃষক খেত চুক্তি আলু বিক্রি করে ফেলেন। স্থানীয় এক কৃষকের কাছ থেকে ৪৮ শতাংশ জমির আলু ও মিষ্টিকুমড়ার ফলন ১ লাখ ১৫ হাজার টাকায় কিনেছেন মিরপুর গ্রামের রুহুল আমিন। স্থানীয়দের কাছে ব্যাপারী নামে পরিচিত রুহুল আমিন নিজেও এ বছর চরের মধ্যে আলুর আবাদ করেছেন ৭ দশমিক ২ একর (১৮ কানি) জমিতে।

 রুহুল আমিন বলেন, ৪৮ শতাংশ জমির আলু তুলতে খরচ হচ্ছে ৮ হাজার টাকার বেশি। গাড়ি ভাড়া দিয়ে এসব আলু দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার বুড়িচংয়ের নিমসারে নিয়ে বিক্রি করবেন। আশা করছেন ভালো লাভ হবে। মাটির নিচে কী আছে, সেটা না দেখেই এভাবে ফসল কেনেন। অনেক সময় লোকসানও হয়।

 স্থানীয় কৃষক আবুল বাশার বলেন, আলু তোলার এই সময়ে এবার এক কানি (৪০ শতাংশ) জমির আলু ও মিষ্টিকুমড়া চুক্তিতে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ১০ হাজারে বিক্রি হচ্ছে। এবার আলুর বীজের দাম বেশি ছিল। যার কারণে কানিপ্রতি কৃষকদের খরচ হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। বাকিটা লাভ হচ্ছে। আবার অনেক কৃষক নিজেরা আলু তুলে বাজারে নিয়ে বিক্রি করছেন। বর্তমানে প্রতি কেজি আলু ৪২ থেকে ৫০ টাকায় পাইকারি বিক্রি হচ্ছে।

আমতলী এলাকার কৃষক হুমায়ুন মিয়া বলেন, গোমতীর চরের আলু খেতে সুস্বাদু। এ জন্য বাজারে এই আলুর চাহিদা বেশি। পুরো চরেই সাদা আলুর চাষ বেশি হয়। তবে এত বড় বন্যা গেলেও কৃষি বিভাগ থেকে কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি। কৃষি বিভাগের সহায়তা পেলে কৃষকেরা উপকৃত হতেন। 

 এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক আইউব মাহমুদ বলেন, আবহাওয়া ভালো ও বন্যায় চরের কৃষিজমিতে পলি জমার কারণে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। বরাদ্দ না থাকায় অন্যভাবে সহায়তা করতে না পারলেও কৃষি কর্মকর্তারা পরামর্শ দিয়ে কৃষকদের সহযোগিতা করছেন। পুরো জেলায় চলতি মৌসুমে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ হাজার ২৫৪ হেক্টর; এর মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে আট হাজার হেক্টর জমিতে আলু রোপণ করা হয়েছে। সামনে আলু রোপণ আরও হবে।