বরিশালে দুই ছাত্রীর পারিবারিক বিরোধ ঘিরে রাতভর সংঘর্ষে জড়াল দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা
বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ ক্যাম্পাস এলাকায় কলেজটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে হওয়া এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ সময় দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চারটি বাস ভাঙচুর হয়।
বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গতকাল রাত একটার দিকে উভয় পক্ষের উত্তেজনা শুরু হয়। এরপর দফায় দফায় চলে হামলা ও সংঘর্ষ। ভোর পাঁচটা পর্যন্ত এই সংঘর্ষ চলে।
দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশফিয়া আক্তার নামে বিএম কলেজের এক শিক্ষার্থীর পরিবারের সঙ্গে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনুভা চৌধুরীর পরিবারের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। বিরোধকে কেন্দ্র করে আশফিয়ার পক্ষে সোমবার রাত ১০টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিএম কলেজের সমন্বয়ক মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ১৫-২০ জন বরিশাল নগরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোডে আশফিয়াদের বাড়িতে যান। পরে তাঁরা বিরোধের বিষয়টি জানতে প্রতিবেশী তাসনুভাদের বাড়িতে গেলে সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে কথা–কাটাকাটি হয়। তাসনুভা ফোনে বিষয়টি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠীদের জানালে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থী ছুটে আসেন। সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে বিএম কলেজের সমন্বয়ক মোস্তাফিজুর রহমানকে মারধর করা হয়। পরে স্থানীয় লোকজন ও সহপাঠীরা সোমবার রাত ১২টার দিকে আহত অবস্থায় তাঁকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। এ ঘটনায় মঙ্গলবার বিকেলে বিএম কলেজ ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাল্টা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
বিএম কলেজের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ও তাঁর সহপাঠীদের অভিযোগ, তাঁরা সোমবার রাতে দুই পক্ষের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধের বিষয়টি জানতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাসনুভা সেখানে তাঁর সহপাঠীদের ডেকে এনে মোস্তাফিজুরকে মারধর করিয়েছেন। মোস্তাফিজুর বরিশাল বিএম কলেজের স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের ছাত্র।
এ অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনুভার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জমিসংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা রাতের বেলা তাঁদের বাড়িতে এসে হুমকি দেন। তখন তিনি বিষয়টি তাঁর সহপাঠীদের জানান। দুই পক্ষে হাতাহাতি হয়েছে। সেখানে কাউকে মারধর করা হয়নি।
সোমবার রাতের ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গতকাল রাত ১০টার দিকে নগরের বটতলা এলাকায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে একা পেয়ে মারধর করেন বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা। তখন প্রাণ বাঁচাতে ওই দুই শিক্ষার্থী দৌড়ে পাশে থাকা বটতলা পুলিশ ফাঁড়িতে ঢুকে আশ্রয় নেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সহপাঠীদের মারধর করার খবর পেয়ে রাত ১২টার দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে করে সেখানে এলে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা ওই বাসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন। এতে বাসের চালকসহ ১৫-২০ জন আহত হন। পরে সহপাঠীদের মারধর করার খবর ছড়িয়ে পড়লে বাস-ট্রাক বোঝাই হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাত একটার দিকে নগরের বটতলা এলাকার আশপাশে এসে জড়ো হন। অন্যদিকে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাস ও এর আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন। এ সময় বিভিন্ন স্থানে উভয় পক্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে রাত দেড়টার দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিএম কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। রাত পৌনে তিনটা পর্যন্ত এই হামলা চলে। হামলার প্রথম পর্যায়ে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা পাল্টা হামলা চালানোর চেষ্টা করলেও সংখ্যায় অনেক কম হওয়ায় বেশি সময় তাঁরা টিকে থাকতে পারেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা তাঁদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। বিএম কলেজের এক শিক্ষার্থী তিনি বিরোধপূর্ণ জমি দখলের চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও তাঁর পরিবারকে হেনস্তা করেছে। আর এর প্রতিবাদ জানাতে গেলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা বলেন, বিরোধ সমাধানের চেষ্টা চালাতে গিয়ে সমন্বয়ক মোস্তাফিজুর রহমানসহ বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা হামলার শিকার হয়েছেন। এর প্রতিবাদ জানাতে গেলে রাতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুধু বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর নয়, কলেজের প্রশাসনিক ভবন, আবাসিক হল ও বেশ কয়েকটি বাস ভাঙচুর করেছেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, হামলাকারীরা লাঠি, পাইপ, রডসহ বিভিন্ন অস্ত্র এবং ট্রাকে পাথর, ইট নিয়ে এসে পরিকল্পিত এই হামলা চালান। হামলায় অন্তত ৭০ জন আহত হয়েছেন বলে তাঁদের দাবি। কলেজের তিনটি বাস, প্রশাসনিক ভবন, ক্লাস রুম, তিনটি হল ও দোকানপাটে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয় বলে তাঁরা অভিযোগ করেন।
স্থানীয় লোকজন বলেন, রাত তিনটার দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষার্থী বিএম কলেজের ভেতরে আটকা পড়ে বলে খবর পাওয়া যায়। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হস্তক্ষেপে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও বিএম কলেজের আশপাশে পাল্টাপাল্টি হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছিল।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর খোরশেদ আলম সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার পরপরই আমরা সেখানে ছুটে যাই। তবে কোনোভাবে দুই পক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। আমাদের পাঁচজন শিক্ষার্থী কলেজের ভেতরে আটকা পড়েছিল। ভোর পাঁচটার দিকে আমরা সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে বিএম কলেজের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি সমঝোতাপত্রে সই করে ওই পাঁচ শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেছি। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। এখনো অন্তত ৪০ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে গেছেন।’
বরিশাল বিএম কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আমিনুল হক আজ সকালে প্রথম আলোক বলেন, ‘আমরা এখনো জানি না আমাদের কতজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তবে সংখ্যায় অনেক। কলেজের অবকাঠামো, তিনটি বাসসহ অনেক ক্ষতি হয়েছে। একাডেমিক কাউন্সিলের সভা ডেকেছি। সভায় আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’