মৌলভীবাজারের গ্রামীণ হাটে চায়ের সঙ্গে ‘টায়ের’ টানে

মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার চৌধুরীবাজারের ‘শাহ মোস্তফা টি পয়েন্ট’ মালিক আবিদুর রহমান ইকবালছবি: প্রথম আলো

দিনে যেমন-তেমন, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে প্রাচীন-গ্রামীণ হাটটি বয়স ভুলে তারুণ্যে জেগে ওঠে। আটপৌঢ়ে ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে অনেক চেনা-অচেনা মুখের ভিড় বাড়তে থাকে হাটটিতে। ছোট-বড় যানবাহনের আনাগোনা বেড়ে যায়। হাটে যেমন ‘সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে’ অনেকটা এ রকমই। তবে এই ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যাকে প্রাণ দিতে যাঁরা ছুটে আসেন, তাঁরা সংসারেরই লোক। তাঁরা আসেন অন্য রকম এক টানে।

আর এই টান তৈরি করেছে আবিদুর রহমান ইকবালের (৫০) ‘শাহ মোস্তফা টি পয়েন্ট’। এখানে আছে অনেক জাতের চা, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাঁস-গরুর মাংসসহ রুমালি রুটি, চালের রুটি। শুধু স্থানীয় মানুষই এখানে ভিড় করেন না। দেশের নানা জেলা ও প্রান্তের মানুষ আসেন—কেউ একা, অনেকে আসেন দলবেঁধে, অনেকে বাসে করে। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার চৌধুরীবাজারে ‘শাহ মোস্তফা টি পয়েন্ট’ চা ও নানা পদের খাবার নিয়ে এখন অনেকেরই আলোচনায়।

দোকানটি ক্রেতার আনাগোনায় মুখর থাকে
ছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের রাজনগর উপজেলার মহলাল বাজার থেকে উত্তর দিকে একটি গ্রামীণ পাকা সড়ক চলে গেছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যার পরপরই এই পথ ধরে যাওয়ার সময় হালকা কুয়াশা নেমেছে। শীতের রাত বাড়ছে। ক্রমশ নিঝুম হয়ে উঠেছে পথটি। পথে তেমন মানুষ বা যানবাহন নেই। পথের দুই পাশের বাড়িগুলো গাছপালাসহ গাঢ় অন্ধকার হয়ে আছে। কিছু দূর যাওয়ার পরই ঝলমল করে ওঠে একটি গ্রামীণ হাট, চৌধুরীবাজার। বাজারটি অনেক পুরোনো। চারপাশের গ্রামের মানুষ সকাল থেকে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত এই হাটে আসা-যাওয়া করেন। শাকসবজি, মাছ-শুঁটকি থেকে মানুষের চাহিদার প্রায় সব রকম পণ্যই আছে হাটটিতে। তবে গত কয়েক বছরে একটি চায়ের দোকান ‘শাহ মোস্তফা টি পয়েন্ট’ এই গ্রামীণ বাজারটিকে গ্রাম ছাড়িয়ে অনেক দূরের মানুষের আলোচনাতে নিয়ে এসেছে।

রাজনগর উপজেলা সদর থেকে টি পয়েন্টে এসেছেন জয়নাল মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। অনেক ভুগতে আছি। কিন্তু কী করব, মন মানে না। খাওয়ার টান পড়লেই এখানে (টি পয়েন্ট) চলে আসি। আমি প্রায়ই আসি। খেতে ভালো লাগে, মজা লাগে। আমার মতো এ রকম আরও অনেকেই আছে।’

চা-পিপাসুদের ভিড়
ছবি: প্রথম আলো

‘শাহ মোস্তফা টি পয়েন্ট’-এর উদ্যোক্তা আবিদুর রহমান ইকবালের ব্যস্ততার শেষ নেই। চারদিকে যেমন খোঁজ রাখতে হয়, প্রয়োজনে রুটি তৈরিসহ নানা রকম কাজও করতে হয়। চৌধুরীবাজারের দক্ষিণ দিকে তাঁর দোকানটি। হাটের দক্ষিণ পাশে একদিকে চা তৈরি হচ্ছে। কারিগরদের দাঁড়িয়ে দম নেওয়ার সুযোগ নেই। একটার পর একটা অর্ডার আসছে, আর চায়ের কাপ তৈরি হচ্ছে। সরবরাহ হচ্ছে। অন্যদিকে আছে মাংস-রুটি। একের পর এক রুমালি রুটি, চালের রুটি তৈরি হচ্ছে। চারটি স্থানে ভাগ হয়ে বসে কেউ চা খাচ্ছেন, কেউ মাংস-রুটি, পেঁয়াজুসহ অন্যকিছু খাচ্ছেন। কোথাও বসার ফাঁকা জায়গা নেই। কেউ বসে খাবারের অপেক্ষা করছেন। কেউ দাঁড়িয়ে আছেন। স্থান ফাঁকা হলেই বসবেন। বিভিন্ন দিকে সারি সারি অনেক মোটর সাইকেল। শুক্র ও শনিবার ভিড়টা বেশি হয়।

আবিদুর রহমান ইকবাল বলেন, তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজার শহরের বনবীথি এলাকায়। শহরের মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল সড়কে তাঁর একটা ওয়ার্কসপ ছিল। নানা কারণে সেই ব্যবসা গুটিয়ে শ্বশুরবাড়ি এলাকা চৌধুরীবাজারে চলে আসেন। ২০০৫ সালের দিকে জীবিকার বিকল্প উপায় হিসেবে চৌধুরীবাজারে একটি সাধারণ মানের চায়ের দোকান খুলেন। তিন-চারজন লোকসহ সেই চায়ের দোকান মন্দ চলছিল না। নিজের সংসারের চাহিদা ওই দোকানের আয়েই চলে গেছে। একটা সময় তিনি দেখলেন, এই চা তৈরিতে ব্যবহৃত গুঁড়া দুধ ও গরুর দুধের অনেক সর জমে থাকে। এই সর কোনো কাজে লাগে না, ফেলে দিতে হয়। মাঝেমধ্যেই এই সরকে কোনোভাবে কাজে লাগানোর কথা ভাবতে থাকেন। ২০১৮ সালের দিকে এই মালাই দিয়ে চা তৈরি করে যাঁরা নিয়মিত দোকানে আসেন, তাঁদের খাওয়াতে থাকেন। যাঁরাই মালাই চা খেয়েছেন, তাঁরা ভালো লাগার কথা জানিয়েছেন। এতে নতুন ধরনের চা তৈরির উৎসাহ বেড়ে যায়। মুখে মুখে তাঁর সুনাম ছড়ায়। লোকজনের ভিড় শুরু হয়।

শুরুর সময় চায়ের কাপ ছিল তিন টাকা। একে একে ২২ রকমের চা এখন তাঁর দোকানে। ১০ টাকা থেকে এক কাপ চা এখন ১০০ টাকা পর্যন্ত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এই ২২ জাতের চায়ের মধ্যে আছে মাখন মালাই, দুধ মালাই, ক্রিম মালাই, শাহী মালাই, গুড় মালাই, তিল মালাই, বাদামি মালাই, রেগুলার মালাই, খেজুরের গুড়ের লাড়া চা, স্পেশাল দম চা, স্পেশাল দুধ চা, গুড়ের দুধ চা, রেগুলার দুধ চা, গ্রিন টি, মালটা রং চা, ব্ল্যাক টি, লেবু রং চা, আদা রং চা, তেতুল রং চা, কাঁচা পাতা রং চা ইত্যাদি। এর মধ্যে শাহী মালাই চা বেশি চলে। এই চায়ের টানে কুমিল্লা, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেট থেকেও অনেকে ছুটে আসেন। প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৪০০ কাপ চা বিক্রি হয়ে থাকে। প্রতিদিন ১২ কেজি প্যাকেট দুধ ও ৬০ থেকে ৭০ লিটার গরুর দুধ লাগে বলে আবিদুর জানালেন।

ছিক্কা গ্রামের কলেজ পড়ুয়া তরুণ মো. কাইয়ুম বলছিলেনন, ‘আমি প্রায় প্রতিদিনই একবার আসি। রেগুলার লাড়া চা (কড়ই গুঁড়ার মিশ্রণে তৈরি) খাই। এটাই আমার বেশি ভালো লাগে। শুক্রবারেই ভিড়টা বেশি হয়। বসার জায়গা মিলে না।’

এই দোকানে ২২ রকমের চা পাওয়া যায়। সঙ্গে থাকে মাংস–রুটি, পেঁয়াজুসহ নানা খাবার
ছবি: প্রথম আলো

আবিদুর রহমান ইকবাল বলেন, শুধু নানা পদের চায়ের মধ্যেই তাঁর ব্যবসা সীমিত ছিল। কিন্তু দূরদূরান্ত থেকে যাঁরা আসেন, তাঁরা চায়ের সঙ্গে আরও কিছু চাইতেন। তাঁদের চাহিদা থেকেই তিনি টি পয়েন্টের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে চালু করেন ‘শাহ মোস্তফা বিরিয়ানি স্টেশন’। এখানে আছে হাঁস, গরু ও মোরগের মাংসের সঙ্গে চালের রুটি, রুমালি রুটি। আছে চুইঝালসহ গরুর মাংস।

গল্পে গল্পে ততক্ষণে শীতের রাতটি আরও গভীর হয়েছে। তবে চা-পিপাসুসহ অন্যদের ভিড় তখনো খুব একটা কমেনি। ঘরে–বাইরে অনেকে দাঁড়িয়ে, অনেকে বসে খোশমেজাজে সময় পার করছেন। হাটের অন্যদিকে ভিড় হালকা হয়ে ভাঙনের টান পড়েছে। টি পয়েন্ট প্রাঙ্গণটি তখনো তারুণ্যে চনমনে হয়ে আছে।