মুন্সিগঞ্জের হিমাগারে আলু বিক্রি বন্ধ ৫ দিন, ‘শেষ দেখতে চান’ ব্যবসায়ীরা
হিমাগার ও খুচরা পর্যায়ে সরকার আলুর দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পর মুন্সিগঞ্জের অধিকাংশ হিমাগারে আলু বিক্রি বন্ধ। দাম বাড়ানো না হলে আলু বিক্রি করবেন না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা এই অবস্থার শেষ দেখতে চান।
এদিকে হিমাগার থেকে আলু আনতে না পারায় সংকট দেখা দিয়েছে খুচরা বাজারে। নতুন করে সরকার নির্ধারিত দামে আলু কিনতে না পারায় খুচরা পর্যায়ে আলু বিক্রি বাদ দিয়েছেন অধিকাংশ সবজি বিক্রেতা। মঙ্গলবার সকালে মুন্সিগঞ্জ বড়বাজার, মুন্সিরহাট, হাটলক্ষ্মীগঞ্জ ও মুক্তারপুর এলাকার বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
খুচরা বাজারে আলুর দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছিল। গত বৃহস্পতিবার সরকার আলুর দাম খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা এবং হিমাগার পর্যায়ে ২৬ থেকে ২৭ টাকা বেঁধে দেয়। তবে এই দাম মানেননি ব্যবসায়ীরা। হিমাগার পর্যায়ে ৩৯ থেকে ৪০ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করতে থাকেন ব্যবসায়ীরা।
গত শনিবার মুন্সিগঞ্জে হিমাগার পরিদর্শনে যান জাতীয় ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। হিমাগার পরিদর্শন শেষে রোববার থেকে পাকা রসিদের মাধ্যমে ২৬ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে পাইকারি এবং খুচরা বাজারে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করতে মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন তিনি। তবে এ নির্দেশনা হিমাগার ও বাজার পর্যায়ের কোথাও বাস্তবায়ন হয়নি।
সবজি বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার হিমাগার পর্যায়ে আলুর দাম বেঁধে দিয়েছে। এই দামে হিমাগারের মজুতদাররা আলু বিক্রি করছেন না। ফলে তাঁরা আলু কিনতে পারছেন না। বেশি দামে আলু কিনে আনলে খুচরা বাজারে বেশি দামে বিক্রি করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তাঁদের আবার জরিমানার মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে। তাই তাঁরা আলু কেনা বন্ধ রেখেছেন।
বড়বাজারের ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান ৩৬ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করছিলেন। তিনি বলেন, ‘৫ দিন আগে ৪০ টাকা করে আড়ত থেকে আলু কিনেছিলাম। সে আলুতে পচন ধরেছে। এদিকে ৩৬ টাকার বেশি দামে আলু বিক্রি করা যাবে না। তাই ৩৬ টাকায় আলু বিক্রি করছি। কেজিতে ৪ টাকা করে লোকসান আমার।’
কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা মো. স্বপন বলেন, ‘আমরা মুন্সিগঞ্জের হিমাগারগুলোতে গিয়েছিলাম। সেখানে কেউ আলু বিক্রি করছেন না। খাবারের হোটেলসহ আমাদের অনেক নির্দিষ্ট ক্রেতা আছেন। তাঁদের এখন আলু দিতে না পারলে আমাদের কাছ থেকে ছুটে যেতে পারেন। তাই বাধ্য হয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়ত থেকে ৩৮ টাকা কেজি দরে আলু কিনেছি। ভাড়াসহ ৪০ টাকা দাম পড়েছে। সে দামেই এখন আলু বিক্রি করছি।’
জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা এ বি এম মিজানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘হিমাগার থেকে ব্যবসায়ীরা আলু ছাড়ছেন না, বিষয়টি আমাদের কানে এসেছে। আমরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছি। খুচরা বাজারে সরকার নির্ধারিত মূল্যে আলু বিক্রির বিষয়ে কৃষি বিপণন অফিস, জেলা ভোক্তা অধিকার ও উপজেলা প্রশাসন সমন্বয় করে কাজ করছে। খুব শিগগির বাজার পরিস্থিতি ঠিক হয়ে আসবে।’
এদিকে মঙ্গলবার সকাল থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত সদর উপজেলার নিপ্পন কোল্ডস্টোরেজ ও বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস কোল্ডস্টোরেজে দেখা গেছে, তাদের আলুর শেড ফাঁকা পড়ে আছে। হিমাগারগুলোতে ব্যবসায়ীরা জটলা করে বসে অলস সময় পার করছেন। সেখানে কোনো ক্রেতা ছিলেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘৩৩ থেকে ৩৪ টাকা করে কৃষকদের কাছ থেকে আলু কিনেছি। সে আলু ২৭ টাকা কীভাবে বিক্রি করব? আমাদের সব ব্যবসায়ীকে নিয়ে একটি গোপন সভা হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সরকার আলুর দাম না বাড়ালে আগামী সাত দিন হিমাগারে কোনো আলু বিক্রি হবে না। আমরাও শেষটা দেখতে চাই।’
নিপ্পন কোল্ডস্টোরেজ এলাকায় মোরশেদ খান নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘সরকারের বাড়াবাড়ির কারণে এখন আলু বিক্রি বন্ধ হয়ে আছে। আমরা আলু বিক্রি করতে চাই। তবে সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, সে দামে নয়।’
বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস কোল্ডস্টোরেজে গেলে কথা মো. নিজাম নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবারের পর থেকে কোনো হিমাগারে আলু বিক্রি হচ্ছে না। হিমাগার থেকে কিছু আলু বের হচ্ছে। সেগুলো দাম নির্ধারণ ছাড়াই চট্টগ্রাম, বরিশালের আড়তে পাঠানো হচ্ছে। সেখানেই দাম নির্ধারণ করে বিক্রি হচ্ছে।
কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিবছর এপ্রিল মাসে যখন হিমাগারগুলো আলু মজুত করে, তখনই সরকারের উচিত মাঠে আলুর উৎপাদন, কৃষকের খরচ, বাজারসহ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে আলুর দাম ঠিক করে দেওয়া। যেন সারা বছর সে দামে আলু বিক্রি হয়। তাহলে কৃষক, ব্যবসায়ী, ভোক্তা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।
হিমাগার তদারকি ও নির্ধারিত মূল্যে আলু বিক্রি নিশ্চিতের বিষয়ে জানতে মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাফর রিপনের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি ধরেননি। তবে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফিফা খান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে খুচরা ও হিমাগার পর্যায়ে আলু বিক্রি নিশ্চিত করতে বাজার ও হিমাগারগুলোতে তদারকি চলছে।