মিল্টনের চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না
‘অনেক স্বপ্ন ছিল আমার ছেলে মিল্টন ডাক্তার হবে। ডাক্তার হয়ে এলাকার মানুষের চিকিৎসা করবে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আল্লাহ, আমার এ কী হইল?’
আজ শনিবার দুপুরে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার ধানশাইল ইউনিয়নের দক্ষিণ কান্দুলী গ্রামের বাড়িতে এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নৌকা ডুবে মারা যাওয়া রংপুর মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোশারফ হোসেন মিল্টনের (২১) বাবা মো. সোহরাব আলী।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে ঝিনাইগাতীর কান্দুলী গ্রামের বাইলসা বিলের নলাডুবা এলাকায় নৌকায় চড়ে বিলে বেড়াতে গিয়ে নৌকা ডুবে মোশারফ হোসেনসহ দুই বন্ধু মারা যান। এ ঘটনায় অসুস্থ হয়ে পড়েন আরও তিনজন।
মৃত শিক্ষার্থীরা হলেন রংপুর মেডিকেল কলেজের (রমেক) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও দক্ষিণ কান্দুলী গ্রামের সোহরাবের ছেলে মোশারফ এবং একই গ্রামের সাদা মিয়ার ছেলে মো. আমানউল্লাহ (২৩)। আমানউল্লাহ উপজেলার তিনআনী আদর্শ ডিগ্রি সরকারি কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
আজ দুপুরে ঝিনাইগাতীর দক্ষিণ কান্দুলী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ওই দুজনের মৃত্যুতে পুরো গ্রামে শোকের আবহ বিরাজ করছে। বাড়ির সামনে একটি চেয়ারে বসে সোহরাব আলী কান্নাকাটি করছেন আর বারবার ছেলের কথা বলছেন। এ সময় শ্রীবরদীর রাণীশিমুল গ্রামের বাসিন্দা ও রমেকের পঞ্চম বর্ষের চূড়ান্ত পর্বের শিক্ষার্থী মো. শফিক আহমেদ এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাসিন্দা ও রমেকের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জুয়েল রানাসহ কয়েকজন এলাকাবাসীকে সোহরাবকে সান্ত্বনা দিতে দেখা যায়।
মোশারফের মা মোর্শেদা বেগম কান্নাকাটি করছেন আর বলছেন, ‘আমার মিল্টন চাঁদের আলো ছিল। কত কষ্ট কইরা ওরে বড় করতাছিলাম। নিজের হাতে ওরে খাওয়াইয়া দিতাম। কিন্তু আল্লাহ ওরে আমার কাছ থাইক্যা কাইড়া নিল। এই কষ্ট আমি কেমনে মাইনা নিমু?’
শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রংপুর মেডিকেল কলেজের হেলিপ্যাড ছাত্রাবাসে থাকত মিল্টন। একই এলাকার ছোট ভাই হিসেবে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আমার। মিল্টন অত্যন্ত ভদ্র ও নম্র স্বভাবের ছেলে ছিল। তাঁর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।’
মৃত মোশারফের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মনিহারি ব্যবসায়ী সোহরাব আলীর তিন সন্তানের মধ্যে মোশারফ ছিলেন সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব মেধাবী ছিলেন। ২০১৯ সালে ঝিনাইগাতীর পাইকুড়া এআরপি উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি এবং ২০২১ সালে শেরপুর সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর রংপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন তিনি। তাঁর স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা করে একজন বড় চিকিৎসক হবেন। কিন্তু তাঁর সে স্বপ্ন পূরণ হলো না।
দক্ষিণ কান্দুলী গ্রামে আমানউল্লাহর বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। আমানউল্লাহর বাবা সাদা মিয়া কৃষিকাজ করেন। তাঁর দুই ছেলের মধ্যে আমানউল্লাহ ছিলেন বড়।
আমানউল্লাহর মা রাশেদা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে লেখাপড়া শিখে সরকারি চাকরি করতে চেয়েছিল; কিন্তু ওর সেই আশা পূরণ হইল না। আল্লাহ আমার বাবারে নিয়া গেছে। কীভাবে আমার বাবারে ভুলমু?’
ঝিনাইগাতী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইস্কান্দার হাবিবুর রহমান বলেন, নৌকা ডুবে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় থানায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাঁদের লাশ গতকাল রাতে দাফন করা হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে ঝিনাইগাতীর কান্দুলী গ্রামের ৮ বন্ধু ঈদের আনন্দ করতে দুটি ছোট নৌকা ভাড়া করে উপজেলার বাইলসা বিলে ঘুরতে যান। একপর্যায়ে বিলের নলাডুবা এলাকায় ঢেউয়ের তোড়ে একটি নৌকা উল্টে যায়। এ সময় আরেক নৌকার বন্ধুরা তাঁদের বাঁচাতে গেলে তাঁদের নৌকাটিও উল্টে যায়। এতে মোশারফ হোসেন, আমানউল্লাহ, তরিকুল ইসলাম, শরিফুল ইসলাম ও মো. সোহেল বিলের পানিতে তলিয়ে যান। অন্য বন্ধুদের ডাকচিৎকারে আশপাশের মানুষ ঘটনাস্থলে এসে তাঁদের উদ্ধার করেন। তবে মোশারফ হোসেন ও আমানউল্লাহ মারা যান।