নেত্রকোনায় উত্তপ্ত ভোটের মাঠ, কী বলছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা

নেত্রকোনায় উত্তপ্ত ভোটের মাঠ। গতকাল শুক্রবার রাতে পূর্বধলায়ছবি: সংগৃহীত

দুই দিন পরেই অনুষ্ঠিত হবে নেত্রকোনা সদর, পূর্বধলা ও বারহাট্টা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রচার ও গণসংযোগ। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ভোটের মাঠ। সেই সঙ্গে হামলা, ভাঙচুর, বিস্ফোরণ ও হত্যার হুমকির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় অভিযান চালিয়ে নয়টি রামদা, একটি চায়নিজ কুড়ালসহ কিছু দেশি অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ।

পূর্বধলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ হোসেনের বিরুদ্ধে পছন্দের এক প্রার্থীকে বিজয়ী করতে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। এসব কারণে এরই মধ্যে একজন প্রার্থী সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।

গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত দফায় দফায় সংসদ সদস্যের পছন্দের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা প্রতিদ্বন্দ্বী দুজন প্রার্থীর বাসার সামনে ককটেল বিস্ফোরণ, নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা, অস্ত্রের মহড়া, ভাঙচুর, মারধর ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ শনিবার সকাল থেকে বেলা একটা পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে কয়েকজন প্রার্থী ও ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা যায়।

রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে অনুষ্ঠেয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পূর্বধলায় চেয়ারম্যান পদে চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রার্থীদের মধ্যে তিনজন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আর একজন বিএনপির সাবেক নেতা। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত প্রার্থীরা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এ টি এম ফয়জুর সিরাজ (মোটরসাইকেল প্রতীক), পূর্বধলা উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক মো. মাছুদ আলম (আনারস প্রতীক) ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মো. জাহিদুল ইসলাম (ঘোড়া প্রতীক)। আর দোয়াত–কলম প্রতীকের অপর প্রার্থী আসাদুজ্জামান উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য ও তাঁতীদল কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি।

তিন প্রার্থী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ হোসেন বিএনপির সাবেক নেতা আসাদুজ্জামানকে তাঁর পছন্দের প্রার্থী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। প্রতীক বরাদ্দের আগে তিনি উপজেলায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আসাদুজ্জামানকে উপস্থিত রেখে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তাঁকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করার আহ্বান জানান।

এ নিয়ে গত ১৬ এপ্রিল প্রথম আলোতে ‘বিএনপির সাবেক নেতাকে প্রার্থী ঘোষণা করলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রার্থীদের অভিযোগ, সংসদ সদস্য তাঁর পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মুঠোফোনে বিভিন্ন ভোটারের কাছে ভোট চাইছেন। এ ছাড়া তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের পদধারী কয়েকজন নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের ব্যবহার করে আসাদুজ্জামানের পক্ষে কাজ করছেন।

পুলিশ অভিযান চালিয়ে এসব অস্ত্র উদ্ধার করেছে
ছবি: সংগৃহীত

এসব কারণে উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী জাহিদুল ইসলাম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। গত মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলা সদরের বালিকা উচ্চবিদ্যালয় রোড এলাকায় তাঁর নির্বাচনী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন তিনি। প্রতীক বরাদ্দের পর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় ব্যালট পেপারে তাঁর নাম ও প্রতীক থেকেই যাচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্থানীয় রাজনীতিতে অস্থির পরিস্থিতি। অস্বাভাবিক টাকার খেলা। পেশিশক্তির মহড়া থেকে আমার কর্মীদের নিরাপদ রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখাই সমীচীন মনে করছি।’

এদিকে মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী এ টি এম ফয়জুর সিরাজ ও আনারস প্রতীকের মাছুদ আলমের দাবি, তফসিল ঘোষণার পর থেকেই সংসদ সদস্য তাঁর অনুসারীদের দিয়ে নানাভাবে হয়রানি ও নির্বাচনী প্রচারে বাধা সৃষ্টি করছেন। তাঁর পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ভোট দিতে চাপ দিচ্ছেন। এতে ভোটাররা দ্বিধাবিভক্তির মধ্যে আছেন।

এ টি এম ফয়জুর সিরাজ বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনা এবার স্থানীয় নির্বাচনে প্রতীক তুলে দিয়ে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। এতে এমপি-মন্ত্রীদের প্রভাব না খাটানোর নির্দেশও দিয়েছেন। কিন্তু সংসদ সদস্য আহমদ হোসেন দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বিএনপির সাবেক ওই নেতার পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন। সংসদ সদস্যের অনুসারী ও দোয়াত-কলমের প্রার্থী আসাদুজ্জামানের কর্মী-সমর্থকেরা তাঁর (সিরাজের) বাসার সামনে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যার আগে দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তিনি শঙ্কায় আছেন।

প্রার্থী মাছুদ আলম বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ খুবই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার রাত ৯টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে সংসদ সদস্যের ভাতিজা সাহাদাত হোসেন (২৫) ও ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচিত মো. আল আমিনের ছেলে সাব্বির হোসেনের (২১) নেতৃত্বে দেশীয় অস্ত্রের মহড়া দিয়ে তাঁর কর্মী-সমর্থকদের ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে জামতলা এলাকায় তাঁর সমর্থক আবদুর রশিদের দোকানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও মারধর করা হয়েছে। লোকজন এগিয়ে এলে হামলাকারীরা তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অস্ত্র দেখিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চলে যান। পরে রাতে বাট্টা এলাকায় তাঁর নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়েছে।

এ ঘটনায় রাতেই ভুক্তভোগী আবদুর রশিদ থানায় মামলা করেছেন। আবদুর রশিদ বলেন, ‘সাহাদাত ও সাব্বিরের নেতৃত্বে দোকানে হামলা করে আমাকে জখম করা হয়েছে, আমার পা ভেঙে দিয়েছে। আমি এখন হাসপাতালে ভর্তি। এ ঘটনায় গতকাল গভীর রাতে ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ১৫ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেছি।’

একটি নির্বাচনী ক্যাম্পে ভাঙচুর চালানো হয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

এ ব্যাপারে জানতে সংসদ সদস্য আহমদ হোসেনের মুঠোফোন ফোন করা হলে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। অভিযুক্ত সাহাদাত ও সাব্বিরের মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে। আর প্রার্থী আসাদুজ্জামানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পূর্বধলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. খবিরুল আহসান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, খবর পেয়ে গতকাল শুক্রবার রাত পৌনে ১১টার দিকে হাসপাতাল রোড এলাকায় পুলিশ নিয়ে অভিযান চালিয়ে একটি মাইক্রোবাস, দুটি মোটরসাইকেল, নয়টি রামদা, একটি চায়নিজ কুড়ালসহ কিছু দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় তিন যুবককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে।

পূর্বধলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আটক তিনজনকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।