যশোরের গদখালীতে ফুলের ‘ব্যবসা দখলে’ যুবদলের দুই নেতা
শতাধিক ব্যবসায়ীর ফুলের ব্যবসা দখলের পাশাপাশি ফুল ব্যবসায়ীদের সমিতিও দখল করেছেন বিএনপি–যুবদলের নেতা–কর্মীরা।
যশোরের গদখালী পাইকারি ফুলের মোকামের শতাধিক ব্যবসায়ীর ফুলের ব্যবসা দখলের অভিযোগ উঠেছে বিএনপি ও যুবদলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাঁদের হুমকিতে চার মাস ধরে ওই ব্যবসায়ীরা বাজারে আসতে পারছেন না। ফুল ব্যবসায়ী না হয়েও গদখালী ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির কার্যালয় দখলে নিয়েছেন নেতারা।
ফুল ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বিএনপি ও যুবদলের লোকজন ব্যবসা কেড়ে নেওয়ায় শতাধিক ব্যবসায়ী মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এই ব্যবসায়ীরা চাষিদের কাছ থেকে ফুল কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে থাকেন। কেউ প্রতিবাদ করলে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে মারধর করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গদখালী ও পানিসারা এলাকার অন্তত ছয় হাজার ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীর মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
১৮ ডিসেম্বর দেখা গেছে, গদখালী ফুলের মোকামে একটি ব্যানার টাঙানো। ব্যানারে লেখা, ‘নবগঠিত গদখালী ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে চাষি ও ব্যবসায়ীদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। সভাপতি আবুল খায়ের, সাধারণ সম্পাদক মো. আবু জাফর, কোষাধ্যক্ষ মিন্টু খান ও সাংগঠনিক সম্পাদক ইমামুল হোসেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমিটির সভাপতি আবুল খায়ের গদখালী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক। সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক। তাঁরা কেউ আগে ফুল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। গত ৫ আগস্টের আগে এই সমিতির আহ্বায়ক ছিলেন পানিসারা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য ও ফুল ব্যবসায়ী শামীম রেজা, সদস্যসচিব ছিলেন খালেক সরকার।
ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ও পানিসারা ইউনিয়নের মাঠে মাঠে গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, লিলিয়াম ফুল এবং ঝাউ আর কামিনীপাতার বাগান। দিগন্তজোড়া ফুলের মাঠ দেখতে প্রতিদিন পর্যটকেরা ভিড় করেন। পানিসারা মোড়ে খুচরা ফুল বিক্রির অন্তত ৫০টি দোকান গড়ে উঠেছে।
খায়ের ও জাফরের বিরুদ্ধে সমিতি দখলে নেওয়ার অভিযোগ করেছেন শামীম রেজা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৩৫ বছর ধরে তিনি ফুল চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপি ও যুবদলের লোকজন সমিতির কার্যালয়, কমিটির সব পদ দখল করেন। তাঁদের কাউকে বাজারে উঠতে দিচ্ছেন না।
অভিযোগের বিষয়ে বিএনপি নেতা আবুল খায়ের বলেন, ‘এই সমিতির তেমন কার্যকারিতা ছিল না। তা ছাড়া এত দিন আওয়ামী লীগের লোকজনের দখলে ছিল সমিতির নেতৃত্ব। আমরা নতুন কমিটি গঠন করেছি। এতে ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা খুশি। কারও ব্যবসায় বাধা দেওয়া হচ্ছে না।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ও পানিসারা ইউনিয়নের মাঠে মাঠে গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, লিলিয়াম ফুল এবং ঝাউ আর কামিনীপাতার বাগান। দিগন্তজোড়া ফুলের মাঠ দেখতে প্রতিদিন পর্যটকেরা ভিড় করেন। পানিসারা মোড়ে খুচরা ফুল বিক্রির অন্তত ৫০টি দোকান গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া গড়ে উঠেছে বিনোদনকেন্দ্র, রেস্তোরাঁ।
এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ ও ব্যবসা সম্প্রসারণে ৩৫ বছর ধরে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করছেন আবদুর রহিম। তিনি যশোর ফুল উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি। ৫ আগস্ট রাতে যুবদলের কর্মী সাব্বির ও আশিকুরের নেতৃত্বে কয়েকজন তাঁকে মারধর করেন বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। বাজারে উঠলে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়। এর পর থেকে তিনি বাজারে যেতে পারছেন না। বাজারে তাঁর ব্যক্তি কার্যালয়ও তালাবদ্ধ। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) পানিসারা শাখার সভাপতি।
আবদুর রহিম বলেন, তাঁরা ফুল চাষ ও ব্যবসা সম্প্রসারণে কোনো রাজনৈতিক দল দেখেননি। সবাই মিলেমিশে ব্যবসা করেছেন। কিন্তু হঠাৎ কী হলো বুঝতে, পারছেন না। বিএনপি ও যুবদলের কয়েকজন ব্যবসায়ীকে মারধর করে ব্যবসা কেড়ে নিয়েছেন। চাষিদের বাজারে হেনস্তা করছেন।
সবাই মিলেমিশে ব্যবসা করেছেন। কিন্তু হঠাৎ কী হলো বুঝতে, পারছেন না। বিএনপি ও যুবদলের কয়েকজন ব্যবসায়ীকে মারধর করে ব্যবসা কেড়ে নিয়েছেন। চাষিদের বাজারে হেনস্তা করছেন।আবদুর রহিম, যশোর ফুল উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি
চাষি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বিএনপি নেতা আবুল খায়ের ও যুবদলের নেতা আবু জাফরের নেতৃত্বে যুবদলের কর্মী সাব্বির, আশিকুর, বাবু, শাওন, মনিরসহ ১৫ থেকে ২০ জন গদখালী ও পানিসারা বাজারের ফুলের ব্যবসা দখল করেছেন।
গদখালী ফুল মোকামে বিশৃঙ্খলার কোনো তথ্য নেই উল্লেখ করে ঝিকরগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবলুর রহমান খান বলেন, কেউ এমন কোনো অভিযোগও করেননি।
জানতে চাইলে ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমরান সামাদ বলেন, ফুল ব্যবসায়ী সমিতি দখলের কোনো তথ্য তাঁর জানা নেই। এমন হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৫ আগস্টের পর কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের কেউ হয়তো ভয়ে বাজারে আসছেন না, এমনও হতে পারে।
সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে ফুল চাষ ও ব্যবসা করেন মিন্টু গাজী। সাত বিঘা জমিতে তিনি জারবেরা, গাঁদা, গোলাপ, রজনীগন্ধা ফুলের চাষ করেছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি গদখালী বাজারে ফুল পাঠালে যুবদলের কর্মীরা আটকে দেন। পরে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে ফুল ছাড়িয়ে নিতে হয়েছে বলে জানান তিনি।
পানিসারা গ্রামের ব্যবসায়ী আবদুর সাত্তার বলেন, ‘গদখালী পাইকারি মোকাম থেকে ফুল কিনে আমি দেশের বিভিন্ন এলাকার দোকানে পাঠাই। বিএনপির কয়েকজন আমার বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে ওই সব দোকানের ব্যবসায়ীর ফোন নম্বর নিয়ে গেছেন। এখন তাঁরা ওই সব দোকানে ফুল পাঠাচ্ছেন। আমি কোনো রাজনীতি করি না। আমি নাকি আওয়ামী লীগ করি, এমন অভিযোগ তুলে বাজারে ব্যবসা করতে দিচ্ছেন না।’