জামালপুরে জামাই মেলায় উৎসবের আমেজ, প্রতিদিনই বাড়ছে ভিড়
চারদিকেই ফসলের মাঠ। মাঝের একটি ফাঁকা জায়গায় বসেছে জামাই মেলা। সকাল থেকে নানা স্থান থেকে সেখানে ছুটে আসে মানুষ। আশপাশের ফসলের মাঠের আইল ধরে এগিয়ে চলা নারী, শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী অধিকাংশ মানুষের গন্তব্য এই মেলা। এটিকে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকার জামাইয়েরা এ সময় শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। তাঁরাই মূলত মেলার বাহারি জিনিসপত্রের ক্রেতা।
জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায় এবার তৃতীয়বারের মতো বসেছে জামাই মেলা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো মেলাটি আয়োজিত হয়েছিল। এবার এটিকে কেন্দ্র উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের এলাকায়। গত মঙ্গলবার থেকে চরপাকেরদহ ইউনিয়নের পলাশপুর বাজার মাঠে শুরু হওয়া এই মেলা চলবে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে নানা প্রজাতির বড় বড় মাছ, মিষ্টিজাতীয় খাবার, শিশুদের খেলনাসহ নানা পণ্যের পসরা সাজানো হয়েছে।
এলাকাবাসী ও মেলার আয়োজকদের সূত্রে জানা গেছে, মেলা চলার সময় প্রতি দুপুরের পর থেকে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। জামাইদের সবচেয়ে বেশি ভিড় চোখে পড়ে দুপুরের ঠিক পর পর। এই মেলার মূল আকর্ষণ বড় বড় সব মাছ। মাদারগঞ্জ উপজেলায় যাঁরা বিয়ে করেছেন, সেই জামাইয়েরা হচ্ছেন ওই মেলাটির মূল ক্রেতা ও দর্শনার্থী। এ ছাড়া এই মেলায় মেলান্দহ, ইসলামপুর উপজেলাসহ সারা জেলার বিভিন্ন এলাকার দর্শনার্থীরাও অংশ নেন।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, জামাইরাসহ সব বয়সের মানুষের মেলায় ঢল নেমেছে। বড় বড় নানা প্রজাতির মাছ, মিষ্টিজাতীয় খাবার, শিশুদের খেলনাসহ নানা পণ্যের দোকান বসেছে মেলায়।
স্থানীয় তেঘরিয়া গ্রামের জামাই রাজু আহাম্মেদ বলেন, তিনি ওই এলাকাতে বিয়ে করেছেন। এবার প্রথম জামাই মেলা উপলক্ষে দাওয়াত পেয়েছেন। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মেলার এক দিন আগেই শ্বশুরবাড়ি এসেছেন। মেলার প্রথম দিন সকালে শ্বশুর ও শাশুড়ি টাকাও দেন, সেই টাকা নিয়ে মেলা থেকে একটি মাছ কিনেছেন। সেখান থেকে শ্বশুর ও শাশুড়ির জন্য কিনেছেন পান-সুপারি। ছোট শ্যালিকার জন্য কিনেছেন মিষ্টান্ন।
আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা যায়, মেলায় প্রসাধনী, খাবার, খেলনা, মিঠাই-মিষ্টান্ন, মাছসহ বিভিন্ন ধরনের তিন শতাধিক দোকান আছে। আছে চটপটি-ফুচকা থেকে মুখরোচক নানা পদের খাবারের দোকানও। শিশুদের বিনোদনের জন্য আছে নাগরদোলা, চরকি, দোলনাসহ নানা আয়োজন। সাজিয়ে রাখা হয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ, গ্রাস কার্পসহ বাহারি মাছ। এসব মাছ জামাইয়েরা কিনে শ্বশুরবাড়িতে যান। প্রতিদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে পুরো মেলা প্রাঙ্গণ।
পলাশপুর গ্রামের জামাই শাহিন মিয়া বলেন, ‘মেলা উপলক্ষে শ্বশুর দাওয়াত করে এনেছেন। মেলায় কেনাকাটা করার জন্য প্রথম দিনই শ্বশুর ১০ হাজার টাকাও দিয়েছেন। পরদিন শাশুড়ি আরও পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন, স্ত্রীকে নিয়ে মেলায় আসছি। একটা বড় কাতল মাছও কিনেছি। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন কিনেছি। শাশুড়ির জন্য পান ও সুপারি কিনেছি।’
মেলাটিকে ঘিরে ঈদের মতোই আনন্দ করা হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা রবিউল ইসলাম। তাঁর ভাষ্য মতে, এলাকার মানুষের মধ্যে মেলা উপলক্ষে চরপাকেরদহ ইউনিয়ন ও আশপাশের বিবাহিত নারীরা তাঁদের স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসেন। আর জামাইকে মেলা উপলক্ষে বরণ করে নেওয়ার জন্য শ্বশুরবাড়ির লোকজন আগে থেকেই নেন নানা প্রস্তুতি। মেলা উপলক্ষে জামাইয়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দেন শ্বশুর বা শাশুড়ি। সেই টাকার সঙ্গে আরও কিছু টাকা যোগ করে জামাইয়েরা মেলা থেকে বড় মাছ, মিষ্টান্নসহ বাহারি জিনিসে কিনে শ্বশুরবাড়ি ফেরেন।
বগুড়া থেকে আসা মাছ ব্যবসায়ী আবদুল মালেক বলেন, গত তিন বছর ধরে এই মেলায় মাছ নিয়ে আসি। এতে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে তৈরি হয়েছে ভালো সম্পর্ক। অনেক ক্রেতার সঙ্গে পরিচিতি হয়ে গেছে। আগে মানুষ বেশি মাছ কিনত আর স্থানীয় মানুষ বেশি থাকত, কিন্তু এখন সারা জেলার মানুষ আসছে।
মেলা আয়োজক কমিটির প্রধান সমন্বয়ক মোখলেছুর রহমান বলেন, ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনায় মেলা জমে উঠেছে। নারী-পুরুষ ও শিশুদের ঢল নেমেছে। আশা করছেন, মেলাটি সুন্দরভাবেই শেষ হবে। মেলায় গতবারের চেয়ে এবার আরও বেশি মানুষের সমাগম ঘটছে। প্রায় সব ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে। মেলায় প্রায় ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার কেনাবেচা হওয়ার আশা করা হচ্ছে।