সামাজিক দায়বোধ থেকে শুরু, এখন লাভের ‘বরইবাগান’ বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তার

পাকা বরই উত্তোলন করা হচ্ছে। গত বুধবার সকালে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাউরভাগেছবি: প্রথম আলো

তখন সময়টা করোনাভাইরাসের কারণে স্থবির হয়েছিল। ছোটাছুটির কাজ ছিল না। হাতে অনেক সময়। সময়টাকে বসে থেকে নষ্ট না করে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে অনেক রকম ভাবনা মাথায়। অন্যদিকে সামাজিক দায়বোধ থেকে দায়িত্ব নেওয়া কিছু সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীর পড়ালেখার খরচ জোগানো নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। এই সংকট থেকে উত্তরণ নিয়েও আছে চিন্তা। উপায় খুঁজতে গিয়ে একটি ভিডিওতে বরই (কুল)বাগান দেখে নিজের ‘বরইবাগান’ করার প্রেরণা তৈরি হয় কৃষি উদ্যোক্তা মো. আবুল ফজলের।

ইচ্ছার সঙ্গে কিছুটা সুযোগও আসে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখ ইউনিয়নের বাউরভাগ গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে চারটি ‘বরইবাগান’। এর একটা ব্র্যান্ড নামও দেওয়া আছে ‘তালুকদার অ্যাগ্রো’। বাগানগুলোর গাছে গাছে এখন সবুজ, লাল ও সোনার রঙের মিশ্রণে ঝুলছে গোলগাল থোকা থোকা বরই। বাড়ির কাছে, ধানখেতের পাশে এই বাগানগুলো গ্রামের ভেতর নিয়ে এসেছে আলাদা সৌন্দর্য।

গত বুধবার সকালে কুয়াশা নেমেছিল মৌলভীবাজারে। জলকণার মতো কুয়াশা ঝরছিল। জেলা সদর থেকে ২০-২২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম বাউরভাগ। কুয়াশা কেটে সেই গ্রামটিতে যখন পৌঁছানো গেছে, তখনো গ্রাম ঘুমিয়ে। শীতে অনেকটাই জবুথবু। জনমানুষের দেখা নেই। মাত্র আমন ধান কাটা হয়েছে। ঘরে ঘরে ধান তোলা শেষ, চলছে অবসর। মৌলভীবাজার-শেরপুর আঞ্চলিক সড়ক থেকে গ্রামের কিছুটা ভেতরে বরইবাগানে গিয়ে দেখা যায় কুয়াশায় ডুবে আছে গাছগুলো। শান্ত, চুপচাপ পরিবেশ। তবে কিছুটা মুখরতাও আছে। অনেকগুলো ঘুঘু পাখি গ্রামটির ঘুম ভাঙাতেই কিনা অবিরাম ডেকে চলছে। গোল সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে, ডালে ডালে ঝুলছে ছোট–বড় অনেক বরই। কোনোটি সবুজ, কোনোটি লাল, কোনোটিতে সোনালি রং ধরেছে। বাদুড় ও অন্যান্য পাখির উপদ্রব এড়াতে গাছের কয়েক সারি পরপর জাল পাতা আছে।

এই কৃষি উদ্যোক্তা বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট অফিসার মো. আবুল ফজল। তিনি প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ছোটবেলা থেকেই কৃষির প্রতি তাঁর টান আছে। সুযোগ পেলেই ফসলের কাছে ছুটে যান। চাকরি অবস্থায় আলাদা করে সময় বের করা বেশ মুশকিল ছিল। তবে মাথা থেকে কৃষির ভাবনা কখনোই হারিয়ে যায়নি। করোনার সময় কাজ তেমন ছিল না। ভাবছিলেন সময়টাকে কাজে লাগিয়ে কোনো কিছু করা যায় কি না। অন্যদিকে সুবিধাবঞ্চিত কিছু শিক্ষার্থীকে তিনি (আবুল ফজল) ও তাঁর স্ত্রী শিক্ষিকা তালুকদার আমেনা ফজল পড়ালেখা করান। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বমুখী সময়ে বেতন থেকে শিক্ষার্থীদের এই বাড়তি খরচ জোগাতে বেশ হিমশিম খেতে হয়। এই শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খরচ জোগাতে প্রথমে ভেবেছিলেন কিছু টাকা ব্যাংকে রেখে দেবেন। তা থেকে যা লাভ আসবে, তাই দিয়ে ওদের পড়ালেখা করানো হবে। কিন্তু কৃষি-গণমাধ্যমকর্মী শাইখ সিরাজের একটি ভিডিও দেখে ‘বরইবাগান’ করার আগ্রহ তৈরি হয়।

গাছে ঝুলে আছে পাকা বরই। বুধবার সকালে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাউরভাগে
ছবি: প্রথম আলো

২০১৯ সালে সদর উপজেলার বাউরভাগে সাড়ে তিন কিয়ার (৩০ শতকে ১ কিয়ার) জমিতে বরই চাষ শুরু করেন আবুল ফজল। প্রতি কিয়ার জমি বছরে ১০ হাজার টাকা করে ইজারা নেন এই উদ্যোক্তা। শিক্ষার্থীদের জন্য যে টাকা ব্যাংকে রাখার চিন্তা করেছিলেন, তার সঙ্গে আরও টাকা যোগ করেন। বাগান করতে গিয়ে প্রথম বছরে প্রায় ছয় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। পরে পর্যায়ক্রমে প্রায় ১০ কিয়ার জমিতে চারটি বরইবাগান গড়ে তুলেছেন। এতে এ পর্যন্ত প্রায় ১৭ থেকে ১৮ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। তবে বিনিয়োগের এই টাকা উঠে এসেছে। এখন বাগানের আয়েই বাগানের খরচ চলছে। চারজন নিয়মিত শ্রমিক আছেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে শ্রমিকেরা বাগান দেখাশোনা ও পরিচর্যা করেন। তাঁদের (শ্রমিকদের) মাসে বেতন আসে ৪০ হাজার টাকা।

আবুল ফজল বলেন, ‘ওদের (শিক্ষার্থীদের) পড়াশোনা করাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম। তখন খরচ দিতে গিয়ে খারাপ অবস্থায় আছি। এই শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছে পাঁচ-সাত বছর ধরে আছে। কারও বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল, কেউ অসুস্থ ছিল। তাদের নিয়ে এসে চিকিৎসা দিয়ে পড়ালেখা করানো হচ্ছে। ভাবলাম, ব্যাংকে না রেখে ওদের জন্য মাটিতেই (জমিতেই) টাকা রাখি। এখন বাগানের আয় থেকেই তাদের পড়ালেখা চলছে।’

এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন অনার্সে পড়ছে, একজন ডিগ্রি ফাইনালে এবং একজন ইন্টারমিডিয়েটে। এই শিক্ষার্থীরাও মাঝেমধ্যে এসে বাগানে কাজ করেন। তবে এই আয় থেকে আরও একটি খাতে তিনি টাকা খরচ করেন। সুনামগঞ্জে তাঁর গ্রামের বাড়ির এলাকায় ফুটবল খেলা হয়। খেলোয়াড়দের জার্সি, পুরস্কার প্রদানসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন খরচের জোগান দেন তাঁর এই বাগানের আয় থেকেই। সব খরচ বাদ দিয়েও তাঁর বছরে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা লাভ থাকছে।

তালকুদার অ্যাগ্রোর বরই বাগান। বুধবার সকালে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাউরভাগে
ছবি: প্রথম আলো

আবুল ফজল জানিয়েছেন, অক্টোবর মাস থেকে বাগানের গাছে গাছে মুকুল আসতে শুরু করে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হতে ফল তোলা শুরু হয়। আড়াই থেকে তিন মাস ফল থাকে। তাঁর বাগানে এমন কোনো রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহার করেন না, যা মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এবার ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে বরই বিক্রি করছেন। এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার কেজি বরই বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাগান থেকেই বেশির ভাগ ফল বিক্রি হয়ে যায়। অনলাইনেও অনেকে অর্ডার দেন।

আবুল ফজল শুধু নিজেই বরইবাগান করে থামেননি; হবিগঞ্জ, সিলেটের সারিঘাট, সুনামগঞ্জসহ কয়েকটি স্থানে চার-পাঁচটি বাগান তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁর বরইবাগানে নুরানি কাশ্মীরি আপেল কুল, অস্ট্রেলিয়ান বল সুন্দরী, ভারত সুন্দরী, চায়না টক-মিষ্টি, নারকেল কুল, জাম্বু কুল ও ঢাকা-৯০ জাতের বরই আছে। সবটা একসঙ্গে পাকে না। পর্যায়ক্রমে একেকটি জাত পাকছে। তাঁর বাগানগুলোতে এখন প্রায় তিন হাজার গাছ আছে। এই বরইকে কেন্দ্র করে তাঁর কিছু ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষাও আছে। এই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব করে তুলতে সময়ের আগেই বিমানবাহিনীর চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন। এক বছর হয়েছে তিনি অবসরে গিয়েছেন।  

আবুল ফজল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন পুরোপুরি চাষি। উদ্যোক্তা হয়ে গেছি। আমি একটা আন্দোলনে নামছি। সিলেট অঞ্চলের বেকার ছেলেমেয়েদের উদ্বুদ্ধ করতে চাই। এরা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে এর চেয়ে বেশি কষ্ট করেও এত টাকা আয় করতে পারে না। আমি আগ্রহী ছেলেমেয়েদের আমার নিজের খরচে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেব। চাই যুবসমাজ কাজে লাগুক। দেশে থেকেই যেন তারা ভালো কিছু করতে পারে। তাদের বোঝাতে চাই, মাটি বেইমানি করে না।’