কৃষকের নামে ধানের নাম ‘হেকিম’, ভালো ফলনে উৎসব করে কাটা শুরু
সাধুপাড়া গ্রামের সাধারণ কৃষক আবদুল হেকিম (৬৫)। বিভিন্ন জাতের ধান নিয়ে গবেষণা করতে করতে তিনি একটি স্থানীয় জাতের ধান পান। তাঁর কাছ থেকে সেই ধানের বীজ নিয়ে চাষ শুরু করেন কৃষকেরা। ধীরে ধীরে জাতটি পরিচিতি পায় ‘হেকিম ধান’ নামে। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও সেই ধানের ভালো ফলন হয়েছে।
গতকাল রোববার ছিল হেকিম ধান কাটার নির্ধারিত দিন। এই দিনটি ঘিরে উৎসবে মেতে ওঠেন ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কামারিয়া ইউনিয়নের সাধুপাড়া গ্রামের কৃষকেরা। ধান কাটতে যাওয়ার আগে জন–উন্নয়নকেন্দ্র নামে নিজেদের সংগঠনের কার্যালয়ে বৈঠকে বসেন কৃষকেরা। কার জমির কী অবস্থা, কার ধান এবার কেমন হলো, তা নিয়ে সেখানে চলে আলোচনা। যুক্ত হন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাও। তিনি কৃষকদের নানা পরামর্শও দেন। পরে সবাই মিলে উৎসব করে মাঠে ধান কাটতে যান।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, সাধুপাড়া গ্রামে একটি সংগঠন করে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে একে অপরের হয়ে কাজ করছেন কৃষকেরা। ভালো ফলন হওয়ায় ‘হেকিম ধান’ কাটার সময় গ্রামে এখন অনেকটা উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। কারণ, কম খরচে হেকিম ধানের ভালো ফলনে লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা।
কৃষকের নামে হলো ধান
স্থানীয় জাতের ধানটি হেকিম নামে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল, তার গল্প জানা গেল আবদুল হেকিমের (৬৫) কাছে। তিনি জানান, ২০০৯ সালের কথা। নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলায় বেড়াতে গিয়ে দেখেন রামেশ্বরপুর কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে ফসলের মাঠে প্লট করে বিভিন্ন জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। সেটি দেখে নিজেও এ রকম ধান চাষে আগ্রহী হন। গ্রামে এসে হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন ধানের সংগ্রহ শুরু করেন। নেত্রকোনা থেকে আনেন কয়েকটি জাতের ধান। ১৩ জাতের ধান নিয়ে ২০১০ সালে শুরু করেন নিজের ‘গবেষণা’।
আবদুল হেকিম বলেন, ‘প্লটে অনেক জাতের ধানের মধ্যে অন্য কোনো ধানের সঙ্গে মিল ছিল না, এমন একটি ধানের চারা পাই। সেই ধানটি আলাদা করে সংরক্ষণ করি। এরপর ২০১৬ সাল পর্যন্ত নিজে সেটি ক্ষুদ্র পরিসরে বাড়াতে থাকি। তা দেখে অন্য কৃষকেরা আগ্রহী হয়।’
দেশীয় কোনো জাতের সঙ্গেই ধানটির মিল নেই উল্লেখ করে আবদুল হেকিম বলেন, ‘যারা আমার কাছ থেকে এ ধানের বীজ নিয়ে যেত, তাদের জন্য শর্ত ছিল যতটুকু বীজ নিবে চাষ শেষে ততটুকু বীজ আমাকে ফেরত দিবে। বছর বছর ফলন ভালো হওয়ায় এবং বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকেরা এ ধানটিতে আগ্রহী হয়। আমার কাছ থেকে ধানটি সংগ্রহ করেছে দেখে গ্রামের মানুষ আমার নামেই ধানের নাম করে ছড়িয়ে দেয়।’ তিনি জানান, ১০ শতক জমিতে ৬-৭ মণ কিংবা তারও বেশি ধান হয়। ২০২০ সাল থেকে ধানটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
আলোকিত হচ্ছেন কৃষকেরা
গ্রামের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে নিজের তিন শতক জমি দেন কৃষক আবদুল হেকিম। অন্যদের সহায়তায় সেখানে তৈরি করা হয় একটি স্থাপনা। কৃষক-জেলে, কামার-কুমার, কুটির শিল্পী, শিক্ষার্থীসহ সব প্রান্তিক মানুষের জন্য কেন্দ্রটির নাম দেওয়া হয় জন–উন্নয়নকেন্দ্র। যদিও কৃষকের মুখে মুখে কৃষক সমিতি নামেই পরিচিত। প্রতি মাসে এক দিন বসে বৈঠক। সাধুপাড়া গ্রামের ২৬ জন কৃষক নিয়ে গঠন করা হয় এ সমিতি। সমিতির সভাপতি আবদুল হেকিম। কৃষকদের কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ (বারসিক) নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
গতকাল সকালে গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকদের এই কেন্দ্রটি বেশ সাজানো–গোছানো। ভেতরে রয়েছে নানা কৃষি উপকরণ। বিলুপ্ত প্রজাতিসহ মাঠে চাষ হয় এমন ৭০টি জাতের ধান ও বিভিন্ন জাতের ২০টি সবজিবীজ কৌটাতে ভরে দেয়ালে সাজিয়ে রেখেছেন। কৃষকেরা চাইলে এখান থেকে ধান সম্পর্কে জানতে ও চাষ কৌশল শিখে যেতে পারেন। এর পরামর্শ দেন কৃষকেরাই। রাইমুহি, কাইনাট, জিরাবাদাম, আবদুল হেকিম, চানমুন্নি, স্বর্ণা, ইঞ্চি, ঝাপিবোরো, কাবুনদুলান, মালা, মাইটা গরল, পঙ্খিরাজ, রহমান ইরি, আরপারিনা, রূপেশ্বর, মুড়াবাজাল, জংলি ইরি, বিশালী বিন্নি, সুবাশ, আজল দিঘি, মাইটাপরলসহ নানা জাতের ধান রয়েছে কৃষক সংগঠনটিতে।
২০০৯ সালে কৃষকের উন্নয়নে সংগঠনটি করা হয় বলে জানান সাধুপাড়া গ্রামের কৃষক আবদুল বারি। তিনি বলেন, ফসলের ক্ষতি থেকে কৃষক বাঁচাতে এটি শুরু হয়। প্রতি মাসে এখানে কৃষকেরা বৈঠকে বসেন। কার ফসলে কী সমস্যা, কার ফসল কেমন হচ্ছে, এ নিয়ে আলোচনা হয়। একে অপরের সঙ্গে সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করলে সমাধান বেরিয়ে আসে। যে বিষয়ে কৃষকেরা জানেন না, সেটির জন্য কৃষি কর্মকর্তারা পরামর্শ দেন। ধানের পাশাপাশি শাকসবজির বীজও আদান–প্রদান করা হয়। এর মাধ্যমে গ্রামের কৃষকেরা উপকৃত হচ্ছেন।
কৃষকেরা কেন আগ্রহী হচ্ছেন
তারাকান্দার সাধুপাড়া ছাড়াও পাশের গৌরীপুর উপজেলাসহ আশপাশের উপজেলার কিছু এলাকাতেও চাষ শুরু হয়েছে হেকিম ধানের। কৃষকেরা বলছেন, এ ধানটির খোসা পাতলা, ওজন বেশি, ভাত খেতে ভালো, চিটা কম, রোগবালাই কম, খরা সহনশীল, হেলে পড়ে না, উচ্চতা হয় মাঝারি, ফলনও ভালো এবং অনুর্বর জমিতে ভালো ফলন হয়। ওজনে ভারী হওয়ায় কৃষকের লাভ বেশি হয়। ১২০ থেকে ১৩০ দিনের মধ্যে ধান ঘরে ওঠে। ফলে দিন দিন ধানটি জনপ্রিয় হচ্ছে চাষিদের কাছে।
সাধুপাড়া গ্রামের আবদুল লতিফ (৬৯) এবার ৮০ শতক জমিতে হেকিম ধানের চাষ করেছেন। কাঠাপ্রতি তাঁর খরচ হয়েছে ৩ হাজার টাকা। ফলনও ভালো হয়েছে। তিনি বলেন, মূলত ধানের চাষে খরচ কম হয়, কিন্তু ফলন হয় ভালো। এ জন্য মানুষের মাঝে এ ধান চাষে আগ্রহ বাড়ছে।
চার বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন মালা বেগম (৪০)। কৃষক সংগঠনটিতে বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গ্রামে মানুষের মুখে মুখে শুনেছি হেকিম ধানের ফলন ভালো। তাই এবার পাঁচ কাঠা জমিতে ধান চাষ করে ফলন ভালো হয়েছে।’
খিচা গ্রামের কৃষক দুলাল মিয়া (৫৫) বলেন, গেল বছর ৫০ শতক জমিতে এ ধানের চাষ করে প্রতি ১০ শতকে ৬ মণ করে ধান হয়েছিল। এবার ৭০ শতক জমিতে হেকিম ধানের চাষ করেছেন। এবারও ফলন ভালো হয়। ধানের বীজ বপন থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত ১২০-১৩০ দিন সময় লাগে।
গতকাল সাধুপাড়া গ্রামে হেকিম ধানের মাঠ উৎসবে আশপাশের আরও অনেক কৃষক যোগ দেন। কৃষক সংগঠনটির তথ্যমতে, তারাকান্দার কামারিয়া ইউনিয়নের চারটি গ্রাম, রামপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম, বিসকা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম, গৌরীপুরের সিধলা, কলমাকান্দার রংছাতি, লেঙ্গুরা ও কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া এলাকায় চাষ হয়েছে হেমিক ধানের। অন্তত ১০৭ জন কৃষক ৩৬৬০ শতক জমিতে এবার এ ধানের চাষ করেছেন। এখন তা কাটার মৌসুম চলছে।
বেসরকারি সংস্থা বারসিকের এলাকা সমন্বয়ক ওহিদুর রহমান বলেন, তাঁদের উদ্দেশ্য কৃষকের উপকরণ যেন কৃষকের কাছেই থাকে। কৃষকের বীজ কেন কোম্পানির জিম্মায় চলে যাবে? হেকিম ধানটি কৃষক গবেষণার ফসল। এটি ছড়িয়ে দিতে মাঠ দিবসে কৃষকদের সহায়তা করা হয়।
হেকিম ধান নিয়ে গবেষণার জন্য ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে আলাপ করা হবে জানিয়ে তারাকান্দা উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আবু সাঈদ তালুকদার বলেন, কৃষকেরা অন্য ধানের চেয়ে হেকিম ধান চাষে বেশি লাভ দেখছেন, সে কারণে আগ্রহ বাড়ছে। স্থানীয় জাত হওয়ায় আবহাওয়ার সঙ্গেও সহজেই খাপ খাওয়াতে পেরেছে ধানটি। এটি আরও ছড়িয়ে দিলে কৃষক উপকৃত হবেন।