মাদারীপুরের কালকিনিতে নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার অভিযোগে বেদেপল্লির অন্তত ২০টি বসতঘরে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দেওয়ার পাঁচ দিনেও মামলা নেয়নি পুলিশ।
হামলার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত কালকিনি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান বাকামিন খানসহ হামলাকারীদের বিচার ও গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত বেদেপল্লির বাসিন্দারা।
শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কালকিনি পৌরসভার চর ঠেঙ্গামারা এলাকার বেদেপল্লিতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। বেদে সম্প্রদায়ের পক্ষে মো. মনির সরদার বলেন, ‘আমরা এই দেশের নাগরিক। অথচ আমাদের আমাদের ঘরবাড়িতে থাকার মতো অবস্থা নেই। হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের পর এখন ছাত্রলীগ নেতা বাকামিন ও তাঁর লোকজন আমাদের হত্যার হুমকি দিচ্ছেন। ঘর থেকে বের হলেই কোপানোর হুমকি দিচ্ছেন। থানার অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দিচ্ছেন। আমরা খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি।’
মনির সরদার অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভালোবাসি। আমরা নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিয়েছি। গোলাপের (আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুস সোবহান গোলাপ) পক্ষে কাজ করেছি, এটাই আমাদের অপরাধ। এই অপরাধে ছাত্রলীগ নেতা বাকামিন তাঁর ২০০ থেকে ৩০০ লোক নিয়ে একযোগে হামলা করে ঘরবাড়িতে ভাঙচুর-লুটপাট করেছেন। আমরা থানায় এজাহার দিয়েছি। আসামি ধরা তো দূরের কথা, তিন দিন হয়ে গেল, আমাদের মামলা রেকর্ডই করা হয়নি। কালকিনি থানার পুলিশ আমাদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করছে না। আমরা সবাই জান নিয়ে এই ভাঙা ঘরে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। এ ঘটনায় আমরা সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।’
বেদেপল্লিতে হামলার ঘটনায় কালকিনি থানায় লিখিত এজাহার দিয়েছেন বেদে সম্প্রদায়ের সুমন সরদারের স্ত্রী অঞ্জনা বেগম। এজাহারে কালকিনি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান বাকামিন খানকে প্রধান করে ৪১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা ১৫০ থেকে ২০০ জনকে হামলার জন্য দায়ী করা হয়।
অঞ্জনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘থানা থেকে বলছে মামলা হবে। কিন্তু বাকামিন ছাত্রলীগ সভাপতি হওয়ায় মামলা হচ্ছে না। বাকামিনের লোকজন একের পর এক হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। বাকামিন আমাকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ঘরবাড়ি যা আছে, তা-ও থাকবে না। আমার ছেলেমেয়েকে কেটে ফেলবেন। আমি কিসের জন্য বাদী হলাম। এখন আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’
অভিযুক্ত বদিউজ্জামান বাকামিন খান মুঠোফোনে বলেন, বেদেপল্লিতে হামলার ঘটনা শুনে গিয়ে দেখেন সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও থামাতে পারেননি। তিনি এ ঘটনায় জড়িত নন। তিনি ঘটনার শুরু থেকে থাকলে এমন পরিস্থিতি হতো না বলে তিনি দাবি করেন।
কালকিনি থানায় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় এ পর্যন্ত চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে নৌকার অনুসারীরাই তিনটি মামলা করেছেন। কালকিনি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মারগুব তৌহিদ আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনী সহিংসতা নিয়ে চারটি মামলা হয়েছে। বেদেপল্লিতে হামলার ঘটনায় আমরা অভিযোগ পেয়েছি। মামলা এখনো রেকর্ড হয়নি। পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করছে। হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযানও চলছে।’
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাদারীপুর-৩ (কালকিনি-ডাসার-সদর একাংশ) আসনে নৌকার প্রার্থী আবদুস সোবহান গোলাপকে ভোট দেয় বেদেপল্লির ৫৬টি পরিবার। নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হেরে গেলে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের সমর্থক কালকিনি উপজেলা ছাত্রলীগের লীগের সভাপতি বদিউজ্জামান বাকামিন খানের নেতৃত্বে গত সোম ও মঙ্গলবার দুই দফা চর ঠেঙ্গামারা গ্রামের বেদেপল্লিতে হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় ২০টি বসতঘরে ভাঙচুর, লুটপাট করা হয়। এ সময় নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন। ঘটনার পরপরই নির্বাচনে পরাজিত আবদুস সোবহান ও বিজয়ী তাহমিনা বেগম তাঁর কর্মীদের নিয়ে বেদেপল্লি পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহযোগিতা করেন এবং অভিযুক্তদের কঠোর বিচার হবে বলে আশ্বস্ত করেন।
নৌকার পরাজিত প্রার্থী আবদুস সোবহান গোলাপ বলেন, নৌকায় ভোট দেওয়া কোনো অপরাধ নয়। বেদে সম্প্রদায়ের ওপর যাঁরা হামলা করেছেন, তাঁরা কাজটি ঠিক করেনি। তাঁরা একাত্তরের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছেন। এই দায় ঈগল প্রতীকের প্রার্থীকে নিতে হবে। কারণ, তাঁর সমর্থকেরা হামলা চালিয়েছেন। হামলায় জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান তিনি।
উল্টো অভিযোগ করে বিজয়ী তাহমিনা বেগম বলেন, ‘বেদে সম্প্রদায়ের বসতঘরে হামলার খবর পেয়েই আমি এলাকা পরিদর্শন করি। ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করি। ওখানে আমার কোনো লোক হামলা করেননি। ওখানে যাঁরা হামলা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমি থানার ওসিকে অনুরোধও করেছি। গোলাপের অনুসারীরাই ক্ষোভে হামলা-ভাঙচুর চালিয়ে আমাদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন।’
মাদারীপুর-৩ আসনে ঈগল প্রতীকে ৯৬ হাজার ৩৩৩ পেয়ে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগম। তিনি কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। অন্যদিকে নৌকা প্রতীকে আবদুস সোবহান মিয়া ৬১ হাজার ৯৭১ ভোট পেয়েছেন। পরাজিত এই প্রার্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক।