আশামণিকে (২০) ফেসবুকে ছবি দেখে পছন্দ করেছিলেন সেনাসদস্য আজিজুল হক (২৩)। এরপর আশামণির পরিবারের কাছে বিয়ের সম্বন্ধ পাঠান আজিজুল। আশামণির পরিবার সেই বিয়েতে রাজি হয়। বছর তিনেক আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়েতে নতুন জামাইয়ের ঘর সাজাতে দুই লাখ টাকার আসবাব কিনে দিয়েছিলেন আশামণির মা-বাবা। যৌতুক বাবদ আজিজুলকে আরও পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। যৌতুকের সেই টাকাকে কেন্দ্র করে শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হতে হয় আশামণিকে। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগে আশামণি নিজেই মা-বাবাকে এসব বিষয় জানিয়েছিলেন বলে তাঁদের দাবি।
আশামণির মা গোলাপি বেগম (৫০) ও বাবা আসাদুল ইসলাম (৬০) আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে এসব বলেন। বেলা ১১টার দিকে বগুড়া শহরের নারুলী আকাশতারা এলাকায় তাঁদের বাড়িতে দুজনের সঙ্গে কথা হয়। বলেন, তাঁদের বড় ছেলে শুভ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে চাকরি করেন। ছেলের সঙ্গেই প্রথম পরিচয় হয় আজিজুলের। এরপর ফেসবুকে ছবি দেখে আশামণিকে পছন্দ করেন আজিজুল।
গোলাপী বেগম বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘বিয়ের পর আশামণি শ্বশুরবাড়িতেই থাকত। চুন থেকে পান খসলেই শ্বশুর-শাশুড়ির নির্যাতন সহ্য করতে হতো। আজিজুলকে জানানোর পর মা-বাবার পক্ষ নিয়ে আশামণিকে উল্টো নির্যাতন করত।’ গোলাপী বেগমের দাবি, মা-বাবা ও ছেলে পূর্বপরিকল্পনা করে আশামণিকে হত্যা করেছেন।
আহাজারি করতে করতে গোলাপী বেগম বলেন, ‘নিষ্পাপ নাতিডার অপরাধ কী? তার কাল্লাডা (মাথা) করতোয়া লদীত ফালা দিল ক্যা? অর ফাঁসি চাই। মেয়েডাক জবাই করলো, অবুঝ নাতিডাক জবাই করলো, অর বিচার না হলে আল্লা বেজার (অখুশি) হবি। মা-বাবাসহ ওই পাষণ্ডটার বিচার চাই।’
আশামণির বাবা আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘বিয়্যার সময় জামাই কচলো, যৌতুক দেওয়া লাগবি না। জামাইয়ের কতাত খুশি হয়্যা হামমি লিজত থ্যাকে শহরত তিন শতক জায়গা কিনে দিবার চাচনু। পরে জমির বদল জামাই পাঁচ লাখ টেকা চাচলো। ধারদেনা করে এক লাখ টেকা দিচনু। বাকি চার লাখ টেকার জন্যি হামার মেয়েডাক জামাই আর শ্বশুর-শাশুড়ি মিলে নির্যাতন করিচ্ছিল। নাতিডার কথা চিন্তা করে সব সহ্য করচিনু। কিন্তু হামার মেয়েডাক এভাবে গরুর মতো জবাই দিল, নাতিডাক ছাগলের মতো জবাই করে মাথাডা নদীত ফ্যালে দিল। মেয়ে আর নাতিক হারানোর এই শোক হামরা ক্যামনে মানে নিমু?’
আশামণির স্বামী অভিযুক্ত আজিজুল হক (২৩) বগুড়ার ধুনট উপজেলার হেউতনগরের হামিদুর রহমানের ছেলে। তিন বছর আগে আশামণিকে বিয়ে করেন আজিজুল। এ দম্পতির সংসারে ছিল এক বছরের ছেলে আবদুল্লাহ আল রাফি। গত শনিবার রাতে বগুড়ার শাজাহানপুরের বনানীতে শুভেচ্ছা আবাসিক হোটেলের কক্ষে স্ত্রীকে হত্যার পর শিশুসন্তানকেও হত্যা করেন আজিজুল। ঘটনার পর গ্রেপ্তার হওয়া আজিজুল গতকাল সোমবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
আজিজুল হক জবানবন্দিতে বলেছেন, তাঁর মা-বাবার সঙ্গে স্ত্রী আশামণির বনিবনা হতো না। ঝগড়াবিবাদ লেগেই থাকত। সাংসারিক অশান্তির কারণে তিনি স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
সোমবার সকালে আজিজুলকে প্রধান আসামি করে শাজাহানপুর থানায় হত্যা মামলা করেন নিহত আশামণির বাবা আসাদুল ইসলাম। ওই মামলায় আজিজুল ও তাঁর বাবা হামিদুর রহমানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
করতোয়া নদীতে শিশুর মাথার খোঁজে তল্লাশি
শিশু আবদুল্লাহ আল রাফির দেহের খণ্ডিত অংশের সন্ধানে আজ তৃতীয় দিনের মতো বগুড়ার করতোয়া নদীতে তল্লাশি অভিযান চালানো হবে। শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম আজ বেলা সাড়ে ৩টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, শিশুর দেহের খণ্ডিত অংশের (মাথা) সন্ধানে করতোয়া নদীতে তল্লাশি অভিযান পরিচালনার জন্য গাবতলী উপজেলা থেকে স্থানীয় ডুবুরি ও জেলেদের ডাকা হয়েছে। তাঁরা করতোয়া নদীর ফতেহ আলী সেতু এলাকায় পৌঁছালেই তল্লাশি অভিযান শুরু হবে।
ওসি বলেন, প্রধান আসামি আজিজুল হকের ভাষ্যমতে, পলিথিন ব্যাগে ভরে তাঁর শিশুসন্তানের দেহের খণ্ডিত অংশ (মাথা) করতোয়া নদীতে ফেলেছেন। করতোয়া নদীর ফতেহ আলী সেতু নির্মাণকাজ চলায় নদীতে বাঁশের আড়াআড়ি সেতু আছে। এ ছাড়া নদী পারাপারে ভাসমান ড্রামও আছে। বাঁশের সেতুর খুঁটি ও ভাসমান ড্রামের কারণে একপাশে প্রচুর কচুরিপানা এবং ময়লা-আবর্জনা জমে আছে। পলিথিনে ফেলা খণ্ডিত মাথা সম্ভবত কচুরিপানা বা ময়লা–আবর্জনার ভেতরে কোথাও ঢুকে পড়েছে। এ কারণে শিশুটির দেহের খণ্ডিত অংশের সন্ধানে তল্লাশি অভিযান বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।