২৪ বছর ধরে বিনা টাকায় খতম তারাবিহ পড়ান তিনি
কিশোরগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র পুরান থানা এলাকায় অবস্থিত শহীদি মসজিদ। এটি জেলার কেন্দ্রীয় মসজিদ হিসেবে পরিচিত। মসজিদটির নাম একসময় পুরান থানা মসজিদ ছিল। ১৯৪২ সালের ২৪ অক্টোবর মসজিদের ভেতরে ব্রিটিশ সেনাদের অতর্কিত হামলা ও গুলিবর্ষণে পাঁচজন মুসল্লি নিহত হন। এ ঘটনার পর থেকে নামকরণ হয় শহীদি মসজিদ। ঐতিহাসিক মসজিদের তিনটি পিলারে এখনো রয়েছে সেই গুলির চিহ্ন।
শহীদি মসজিদে ২৪ বছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকে খতম তারাবিহ পড়াচ্ছেন মাহফুজুর রহমান (৫৪)। স্থানীয়ভাবে তিনি হাফেজ ও মাওলানা মাহফুজ হুজুর নামে পরিচিত। অবশ্য এই মসজিদে একাধারে ৪২ বছর খতম তারাবিহ পড়িয়ে নজির সৃষ্টি করেছিলেন আজহার আলী আনোয়ার শাহ।
মাহফুজুর রহমান ১৯৯৩ সাল থেকে আনোয়ার শাহের পেছনে শ্রবণকারী হিসেবে দ্বিতীয় ইমামের দায়িত্ব পালন করেন। তবে ২০০১ সাল থেকে তিনি খতম তারাবিহর নামাজ পড়ান। বর্তমানে মাহফুজুর ছাড়াও মাহমুদুল হাসান ও আতহার রাসেল খতম তারাবিহ পড়ান। এর মধ্যে প্রথম আট রাকাত নামাজ পড়ান মাহফুজুর। বাকি নামাজ পড়ান দুজনে মিলে।
মাহফুজুর রহমান বলেন, মসজিদ–সংলগ্ন আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়া হিফজুল কোরআন বিভাগ থেকে ১৯৮২ সালে মাত্র এক বছরে পবিত্র কোরআন মুখস্থ করেন তিনি। তখন তাঁর বয়স ছিল ১২ বছর। ১৯৯৩ সালে শহীদি মসজিদে আল্লামা হাফেজ মাওলানা আনোয়ার শাহের পেছনে সাধারণ মুসল্লি হিসেবে তারাবিহর নামাজ পড়ছিলেন। একদিন পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের সময় ইমামের দৃষ্টিগোচরের জন্য তিনি লোকমা দেন (নামাজে ইমাম ভুল করলে মুসল্লিদের কর্তব্য লোকমা দিয়ে শুধরে দেওয়া)। নামাজ শেষে ইমাম আনোয়ার শাহ বলেন, ‘কে লোকমা দিয়েছিল?’ আমি দাঁড়াতেই উনি (আনোয়ার শাহ) মোয়াজ্জিনকে ডেকে বললেন, ‘একটি জায়নামাজ এনে আমার পেছনে দাও। আজ থেকে আমার পেছনে তুমি নামাজে দাঁড়াবে এবং তেলাওয়াত শ্রবণকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।’ এভাবেই দায়িত্ব পান তিনি। এরপর আট বছর হুজুরের পেছনে শ্রবণকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে তারাবিহর নামাজ পড়ানো শুরু করেন তিনি।
মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতে, ওস্তাদদের নেক দোয়ায় ও মুসল্লিদের ভালোবাসায় এত বছর সুস্থ থেকে একই মসজিদে টানা তারাবিহর নামাজ পড়ানোর সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছি। তারাবিহ পড়াতে গিয়ে অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। অনেক বড় বড় আলেম ও সরকারি কর্মকর্তা এখানে নামাজ পড়েন। আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে, এ মসজিদে আমি দুই প্রজন্মকে তিলাওয়াত শোনাতে পেরেছি। আমার কোনো চাওয়া–পাওয়া নেই। যত দিন সুস্থ থাকব, পবিত্র কোরআনের খেদমতের মাধ্যমেই মসজিদে বাকি জীবন অতিবাহিত করতে চাই।’
মসজিদটিতে নিয়মিত নামাজ পড়েন হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমি বিভিন্ন মসজিদে প্রায় ২০ বছর খতম তারাবিহর নামাজ পড়িয়েছি। এখন আর ইমামতি করি না। বেশ কয়েক বছর ধরে শহীদি মসজিদে নিয়মিত তারাবিহ পড়ছি। আমার সঙ্গে এখন আমার ছেলে ফাহিমও নিয়মিত এই মসজিদে তারাবিহ পড়ে। হাফেজ মাহফুজুর রহমানের পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত অনেক শ্রুতিমধুর এবং তিনি প্রতিটি হরফের স্পষ্ট উচ্চারণের পাশাপাশি নিখুঁত তিলাওয়াত করেন। তাঁর তিলাওয়াত শুনতে অনেক ভালো লাগে।’
মাহফুজুর রহমান কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের চর শোলাকিয়া এলাকার মৃত মফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি এক মেয়ে ও দুই ছেলের জনক। তাঁর দুই ছেলে হুজাইফা ও মুয়াজ পবিত্র কোরআনের হাফেজ। মাহফুজুর দাওরায়ে হাদিস পাস করার পাশাপাশি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। তিনি হুফ্ফাজুল কোরআন ফাউন্ডেশন কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সেক্রেটারি এবং মিফতাহুল উলুম মহিলা মাদ্রাসার পরিচালক।
শহীদি মসজিদের মোতোয়ালি ও আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা শাব্বির আহমাদ প্রথম আলোকে বলেন, শহীদি মসজিদ হলো কিশোরগঞ্জ জেলার কেন্দ্রীয় মসজিদ। এখানে তারাবিহ ও জুমার নামাজ আদায়ের জন্য আশপাশসহ দূর-দূরান্ত থেকে প্রায় ১০ হাজার মুসল্লির সমাগম ঘটে। এখানে হাফেজ মাহফুজুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে তারাবিহর নামাজ পড়াচ্ছেন। তাঁর শ্রুতিমধুর ও সুন্দর তিলাওয়াতে সবাই মুগ্ধ। যত দিন তিনি নামাজ পড়াতে সক্ষম হবেন, তত দিন এখানেই নামাজ পড়াবেন। এটাই মসজিদ কমিটিসহ সব মুসল্লির চাওয়া। বর্তমানে মসজিদে হাফেজ মাহফুজুর ছাড়াও আরও দুজন হাফেজ খতম তারাবিহ পড়ান। এর বিনিময়ে তাঁরা কোনো বেতন নেন না। কমিটি দিতে চাইলেও তাঁরা নিতে রাজি নন। বলা চলে বিনা পয়সায় তাঁরা তারাবিহর ইমামতি করেন।